বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২৯, ২০১০

শিক্ষা, মূল্যবোধ ও সামাজিক অবক্ষয় (দৈিনক ডেসটিনি ২৯ এিপ্রল ২০১০)


শিক্ষা, মূল্যবোধ ও সামাজিক অবক্ষয়মাহফুজুর রহমান মানিক
শিক্ষা কী? এ প্রশ্নটির উত্তর দিতে দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, মনীষী অনেকেই গলদঘর্ম হয়েছেন। দুই অক্ষরের এ শব্দটির ব্যাপকতা এত বেশি যে একে একটি বা কয়েকটি বাক্যের ফ্রেমে আবদ্ধ করা অত্যন্ত কঠিন। তবুও একে সবাই নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে সংজ্ঞায়ন করার চেষ্টা করেছেন। শিক্ষার গ্রহনযোগ্য সংজ্ঞা আর পরিচিতি যাই বলি, সেটা হলো- ‘আচরণের কাংখিত এবং ইতিবাচক পরিবর্তন’। অর্থাৎ যে মানুষটি শিক্ষাগ্রহন করবে তার আচরণটি হবে কাংখিত এবং ইতিবাচক। ব্যক্তির আচরণ আগে যাই থাকুক শিক্ষা অর্জন বা গ্রহনের মাধ্যমে তার আচরণের অনিবার্যভাবে পরিবর্তন ঘটবে। এ পরিবর্তন তার সমাজ পরিবেশ এবং প্রতিবেশ দ্বারা স্বীকৃত।শিক্ষার কথা বললে অবশ্যম্ভাবিভাবে মূল্যবোধটি আমাদের সামনে ধরা দেয়। মূল্যবোধ সেটিই যাকে আমরা মূল্য দেই কিংবা সমাজ যে বিষয়গুলোর উপর মূল্য আরোপ করে। এ মূল্যটা একধরনের মান বা স্ট্যান্ডার্ড। যেটা নির্ধারণ হয় সমাজের নির্ধারিত নর্মস তথা সামষ্টিক গ্রহনযোগ্য আচরণ এবং ইথিকস তথা নৈতিকতার দ্বারা। সমাজের নর্মস এর ভিন্নতায় মূল্যবোধের বিভিন্নতা দেখা যায়। যেমন হতে পারে একটা বিষয় আমাদের দেশে নর্মস কিন্তু আমেরিকায় নয়।সামাজিক নর্মস বা ইথিকস ভঙ্গ হলে বা এর বাইরে কাজ করলে আমরা তাকে দেখি মূল্যবোধের অবক্ষয় হিসেবে। এ মূল্যবোধের অবক্ষয় মানে সামাজিক অবক্ষয়। সামাজিক অবক্ষয় আর শিক্ষা এবং মূল্যবোধ পরস্পর বিরোধী। যারা শিক্ষা অর্জন বা গ্রহন করছে তাদের মূল্যবোধের অবক্ষয় বা তাদেও দ্বারা সামাজিক অবক্ষয়মূলক কাজ সংগঠিত হওয়া অসম্ভব।শিক্ষাকে আমরা যদি একটা ফলযুক্ত গাছের সাথে তুলনা করি বিষয়টা সহজেই বুঝে আসবে। যে গাছে ফল রয়েছে সে গাছটি ফলের ভারে সবসময় নিচু থাকে। যে গাছে যত ফল সে গাছ তত নিচু। সে ফলের দম্ভ প্রকাশ করতে কখনেই মাথা উঠায় না। একজন শিক্ষিত মানুষ যত যত বেশি জ্ঞানী তার ব্যবহার তত মার্জিত, মানুষ হিসেবে তিনি তত বিনয়ী। সামাজিক আচরণ আর শৃংখলার প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল। গাছের ফলটি যেমন অন্যের জন্য ঠিক সে ব্যক্তিটিও হয়ে যান সমাজের জন্য। তার দ্বারা সামাজিক মূল্যবোধ বিরোধী কাজ হওয়া তো দূরে থাক বরং তিনি এ মূল্যবোধ রক্ষায় বেশি সচেষ্ট থাকেন।আমাদের সমাজের বাস্তব অবস্থাটা সম্পূর্ণ বিপরীত। আমাদের দেশে এ বিপরীত চিত্র এতটাই স্বাভাবিক , বাস্তবতা দেখে মনে হয় যেন শিক্ষাই সামাজিক রীতি-নীতি ভাঙ্গার একমাত্র মাপকাঠি। যিনি যত শিক্ষিত সামাজিক আইন, মূল্যবোধ ভাঙ্গতে তিনি তত সিদ্ধহস্ত। অবস্থাটা এমন পাশ্চাত্যের ধারণা অনুযায়ী একটা মিথ্যা কথাকে একশত বার সত্য বললে মিথ্যাটি আর মিথ্যা থাকেনা সেটি সত্য হয়ে যায়। অর্থাৎ শিক্ষার বিপরীতমুখী এখানে এতটাই প্রবল যার ফলে শিক্ষিত মানুষ মাত্রই অনেকের কাছে খারাপ।স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন করার বিষয় হলো- এটা কেন? উত্তরটা এত সহজে দিতে না পারলেও সাদামাটাভাবে যেটা বলা যায়, আমরা শিক্ষা অর্জন করছি ঠিকই কিন্তু শিক্ষিত হচ্ছিনা। বা শিক্ষাকে মানার জন্য পড়ছি। এ বিষয়ে পরে আসছি।সাম্প্রতিক সময়ে দেশব্যাপি সামাজিক অবক্ষয়ের যে মিছিল দেখা যাচ্ছে এটা তারই প্রমাণ। নারীর প্রতি সহিংসতা, উত্যক্তকরণ, ধর্ষণ, নির্যাতন, আতœহত্যা করতে বাধ্যকরণ ইত্যাদি আগের চেয়ে এতবেশি বেড়ে গেছে যা বলাবাহুল্য। গণমাধ্যমের কল্যানে প্রত্যেকদিনই এসব দেখছি। অনেকে এসব ঘটনার বাড়তিকে আইয়ামে জাহেলিয়াতকে ছাড়িয়ে যাওয়ার বিষয় হিসেবে দেখছেন। আমাদের জাতীয় জীবনের দূর্ভোগ এসব সামাজিক অবক্ষয়ের কারণেই বেড়ে গেছে। শুধু নারী নির্যাতন বা নারীঘটিত বিষয়ই নয়- এর বাইওে দূর্নীতি, ঘূষ, প্রতারণাসহ নানা ধরণের সামাজিক অবক্ষয়মূলক কাজ স্পষ্ট। বর্তমানে বিদ্যুত, গ্যাস, পানির আকাল চলছে। আমাদের চাহিদার তুলনায় এ সম্পদগুলো কমই। ফলে জনগণ অতিষ্ঠ। এরপরও এগুলোর চুরি আর দূর্নীতির সংবাদ আমাদের জন্য কতটা লজ্জাকর। দেখা গেছে এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কর্মচারীর বেতন ১০-১৫ হাজার টাকা হলেও অনেকেরই ঢাকায় রয়েছে নিজস্ব বাড়ি গাড়ি। আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার ঘটনা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।খোদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার প্রতি কতটা বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে উঠছে ছাত্রী নির্যাতনের অভিযোগ। কয়েকজন শিক্ষক আর কয়েকটি ঘটনায আমাদের পুরো শিক্ষক সমাজটাই কিছুটা প্রশ্নবিদ্ধ।শিক্ষকদের যখন এ অবস্থা শিক্ষার্থীর আবস্থা কী? বর্তমানে ছাত্র সমাজেরও মূল্যবোধের ভয়াবহ রকমের অবক্ষয় ঘটেছে। পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনসার্টে ১৫ তরুণীর নির্যাতিত হওয়ার ঘটনা। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কর্তৃক তরুনী লাঞ্চিত ইত্যাদি খবর সে বিষয়টাই জানান দিচ্ছে।গত মাস এবং এ মাস জুড়ে সংবাদপত্রের কিছু সংবাদ মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আবস্থা বুঝতে কারোই কষ্ট হওয়ার কথা নয়। রাজধানীর ডেফোডিল ইউনিভার্সিটির শিক্ষাথী কর্র্তৃক তার মেয়ে ব›ধু ও তার বাবা-মায়ের জখমের ঘটনা। ২৪ মার্চ ঢাকার কালাচাঁদপুরে মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজি না হওয়ায় মা বাবাকে হত্যা। ১৭ এপ্রিল রাজধানীর ভিকারুন্নেসা সহ দুই কলেজ ছাত্রীর আতœহত্যা ইত্যাদি শিক্ষার্থীদেও নৈতিক অবক্ষয়েরই পরিচায়ক।আজকের যুব সমাজের নতুন নাম বেশি আলোড়িত হচ্ছে‘বখাটে’। এ বখাটেপনার বলি হয়ে কত মেয়ে যে আতœহত্যা করছে তা ইয়ত্তা নেই। ৩ এপ্রিলে বখাটে রেজাউলের উৎপাতে বিষপানে আতœহত্যা করে ইলোরা। এভাবে বখাটেপনার শিকার হয়ে ইলোরার দল ভারী করেছে সিমি,ফাহিমা, পিংকী ও তৃষ্ণারা। এর বাইরে আরো জঘন্য অনেক কাজ হয়েছে। এসব কাজের হোতাদের বখাটে নয় নরপশু বলাই শ্রেয়। যারা দলবেঁধে ১৫ বছরের মেয়েকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। যাদের পাশবিক লালসা চার বছরের এমনকি আড়াই বছরের কন্যাকেও ছাড়েনি।আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য দিয়ে গত ৭ মার্চ একটি জাতীয় দৈনিকে প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০০৯ সালে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৯৪ জনকে। গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৫৮ জন আর ধর্ষণের মামলা হয়েছে ২৪৪ টি। মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের তথ্যানুযায়ী গত দশ মাসে ৬০০ জন নারী ভয়াবহ সহিংসতার শিকার।নারীর প্রতি এসব সহিংসতা যেমন বাড়ছে সাথে সাথে আইন শৃংখলারও অবনতি ঘটছে। ২০ এপ্রিল রাজধানীতে সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হয়েছেন পুলিশের এস আই গৌতম। এর আগেও ঘটেছে অনেক হত্যাকান্ড। এরপরও আমাদের মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য- দেশের আইন-শৃংখলা ঠিকই আছে। দেশে যখন সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হচ্ছে মানুষ, একের পর নারীরা হচ্ছেন ধর্ষণের শিকার। এরপরও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এ বক্তব্যে একজন নাগরিকের মন্তব্য এরকম- ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একজন মহিলা। মহিলাদের প্রতি সহিংসতা, নির্যাতন, ধর্ষণ মারাতœক আকার ধারণ করেছে। এ অবস্থায়ও যদি আইন-শৃংখলা ঠিক থাকে, তাহলে ঠিক কত নারী ধর্র্র্ষিতা হলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলবেন এবার আইন শৃংখলার অবনতি হয়েছে’।বর্তমান এ সামাজিক অবক্ষয়ের স্বরূপ অন্বেষণে সম্প্রতি রাজধানীতে গোলটেবিল বৈঠক করেছে একটি সংগঠন। “সামাজিক অবক্ষয়: আমাদের নতুন প্রজন্ম ’ শীর্ষক এ গোলটেবিল বৈঠকে বিশেষজ্ঞদের গবেষণায় যেটা বের হয়ে এসেছে সেটা হলো- ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার অভাব। ঠিক এ বিষয়টির সমর্থণ পাওয়া যায় পাশ্চাত্যের একজন মনীষীর কথা থেকে- (বাংলায় সেটি) ‘ যদি তোমার শিশুকে তিনটা আর (জ) শেখাও রিডিং (পড়া), রাইটিং (লেখা), এরিথমেটিক (গনিত শাস্ত্র) এবং চতুর্থ আর ((জ) রিলিজিয়ন তথা ধর্মকে ছেড়ে দাও ( না শেখাও), তবে অনিবার্যভাবে পঞ্চম আর পাবে সেটা হলো রাসক্যালিটি তথা বদমাইশি।” ধর্মীয় শিক্ষা মানুষের মূল্যবোধকে জাগ্রত করে এটি ছাড়া অবক্ষয় যে অবশ্যম্ভাবী সে বিষয়টিই এ মনীষী তুলে ধরেছেন।এটাকে প্রধান কারণ ধরে আনুষঙ্গিক আরো কারণ বের করা যায়। অনেকে মিডিয়ার প্রভাবের কথা বলেছেন। অনেকে বলেছেন নেশা জাতীয় দ্রব্য তথা মদ, গাঁজা, ফেন্সিডিল ইত্যাদিও অবাধ ব্যবহার। ছেলে মেয়ের অবাধ মেলামেশা কিংবা মেয়েদের অশালীন পোশাককেও দায়ী করেছেন অনেকে। অনেকে আবার ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে , ধর্মকে বাস্তব জীবনে পালন না করার বিষয়টিও বলছেন। কারণ প্রত্যেক ধর্মেই অনৈতিক, সামাজিক অবক্ষয়মূলক কাজ নিষিদ্ধ।এসব ঠিকই আছে, তবে আমাদের সমাজকে অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে অবশ্যই জোর দিতে হবে শিক্ষার উপ্র। যে বিষয়টি প্রথমেই উল্লেখ করা হয়েছে। আমাদের শিক্ষা হবে জানা এবং মানার জন্য। পরীক্ষায় পাশ কিংবা চাকরির চিন্তা থাকবেই কিন্তু সেটাই একমাত্র লক্ষ্য হবে না। একজন মনীষীকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো- শিক্ষিত কারা, উত্তরটা ছিলো যে জানে এবং সেটা বাস্তব জীবনে পালন করে। সুতরাং জানার নাম শিক্ষা নয়, মানার নাম শিক্ষা।এক্ষেত্রে নৈতিক শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ আবশ্যক। এবারের শিক্ষানীতিও সে বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে। ধর্ম এবং নৈতিক শিক্ষা নামে শিক্ষানীতিতে উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে- ‘শিক্ষার্থীদের বাংলাদেশের মূল চারটি ধর্ম সম্পর্কে পরিচিতি, আচরণগত উৎকর্ষ সাধন এবং জীবন ও সমাজে নৈতিক মানসিকতা সৃষ্টি একং চরিত্র গঠন’।নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে আমাদের রাষ্ট্রীয় আইন আছে। কঠোর আইন। গত বছর প্রণীত এ আইনে বলা হয়েছে, কোন নারীর প্রতি একনাগারে তাকিয়ে থাকাও নারী নির্যাতনের অন্তর্ভূক্ত আর ইভটিজিং তো বটেই। এসব কঠোর আইন থাকা স্বত্ত্বেও কিন্তু বন্ধ হয়নি নারী নির্যাতন। অর্থাৎ আইন করে নারী নির্যাতন বন্ধ কারা সম্ভব নয়। স্কুলের সামনে সাদা পুলিশ মোতায়েন করেও নয়। এটি বন্ধে প্রয়োজন মানুষের মাঝে নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করা। সেজন্যই শিক্ষার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।বাংলাদেশের জন্য দুঃসংবাদই বটে, যেখানে আমাদেরও প্রধানমন্ত্রী নারী, বিরোধী দলীয় নেত্রী নারী, স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র মন্ত্রীসহ অনেক মন্ত্রী ও এমপি নারী। নারীর ক্ষমতায়নের দিক দিয়ে এক অবিস্মরণীয় কাল চললেও নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ হয়নি একটুও।মূল্যবোধ শিক্ষাই আমাদের এ সমস্যা থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারবে। শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকেই এ মূল্যবোধ জাগিয়ে তুলতে হবে। শিক্ষার প্রতিটা স্তরে মূল্যবোধ তা নৈতিক শিক্ষাকে আবশ্যক করে একে কার্যকরভাবে শ্রেণীতে উপস্থাপন করা দরকার। এ মূল্যবোধ শিক্ষা নিশ্চয় শিক্ষার্থীকে একদিকে যেমন দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ জাগ্রত করবে অন্যদিকে সামাজিক অবক্ষয়মূলক কাজ হতে বিরত রাখবে।

বুধবার, এপ্রিল ২১, ২০১০

প্রশ্নবিদ্ধ ক্যাম্পাস নিরাপত্তা (দৈনিক ডেসটিনি ২১ এপ্রিল ২০১০)


প্রশ্নবিদ্ধ ক্যাম্পাস নিরাপত্তা
মাহফুজুর রহমান মানিক

দুই মাস পাঁচ দিনের মাথায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবিতে) তিন শিক্ষার্থী খুন। গত ১৫ এপ্রিলের ঘটনায় ১৬ তারিখ সর্বশেষ খুন হওয়া আসাদ বিবিএর (অ্যাকাউন্টিং) এর শিক্ষার্থী। এর আগে ১১ ফেব্রুয়ারি খুন হওয়া মহিউদ্দিন এবং ২৯ মার্চ খুন হওয়া হারুন-অর-রশিদ আর এবারের আসাদ হত্যা, তিনজনের খুনের মোটিভ বলা চলে একই ধরনেরর। তারা কোন প্রত্যক্ষ মারামারি কিংবা সামনাসামনি স্পষ্ট শত্রুদের হাতে খুন হননি। খুন হয়েছেন ক্যাম্পাসের আশেপাশে। শাটল ট্রেনের স্টেশনে। চবির এ নিয়মিত হত্যাকান্ড ক্যাম্পাসকে করেছে অস্থিতিশীল। শিক্ষার্থীরা রয়েছে চরম আতংকে। এ তিনজনের মিছিলের পরবর্তী শিকার কে এ নিয়ে তাদের ভয়।
চবির এ ধারাবাহিক হত্যাকান্ডে অন্তত একটা বিষয় স্পষ্ট, ক্যাম্পাসটি একটি সন্ত্রাস কবলিত ক্যাম্পাস। যেখানে নিয়মিত হত্যা-সন্ত্রাসের ধারাবাহিকতায়ই এসব সন্ত্রাসী কার্যক্রম চলছে। ১১ ফেব্রুয়ারি প্রথম শিক্ষার্থী যখন নিহত হয় তখন গোটা দেশের ক্যাম্পাস ছিলো উত্তাল। বিশেষ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ কর্মী ফারুক হত্যা এবং এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরীহ ছাত্র আবু বকর হত্যা। সেসময়ে চবির হত্যাকান্ডটি অন্যান্য ক্যাম্পাসের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা বললেও, ঘটনা কিন্তু এক নয়। সে হত্যার পর দু’মাস পেরুলে ও অপরাধীরা এখনও ধরাছোয়ার বাইরে।
প্রথম হত্যাকান্ডটি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করলে ও দ্বিতীয়টি ততটা আলোড়ন সৃষ্টি করেনি। এখন অবশ্য তৃতীয়টা ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। কারন একেতো খুন হওয়া শিক্ষার্থীটি ছাত্রলীগ কর্মী অন্যদিকে এটি খুনের হ্যাট্রিক।
এ হত্যাকান্ডের পরই ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে মিছিল করেছে। ভিসি প্রক্টরের পদত্যাগ দাবি করেছে এবং অনির্দিষ্ট কালের জন্য ধর্মঘট ডেকেছে। প্রথম অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের তিনদিনের কাস ও পরীক্ষা স্থগিতের নির্দেশে ছাত্রলীগ ধর্মঘট প্রত্যাহার করে, পওে আবার ধর্মঘটের ডাক দেয়।
সংবাদপত্রের ভাষ্য অনুযায়ী গ্রামবাসীর হাতে নিহত হয় আসাদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকটস্থ জোবরা গ্রামের সন্ত্রাসীদের হাতে শাটল ট্রেনের স্টেশনে আড্ডারত আসাদ এবং তার সহপাঠীরা জখম হয়। দেখার বিষয় হলো এবারের হত্যাকান্ড আর আগের দুটি হত্যাকান্ড একই জায়গায় সংঘঠিত হয়। শেষ আসাদ খুনের বিষয়টিকে আপাত দৃষ্টিতে একটা ঘটনার কারনে হয়েছে বলা গেলেও আগের দুইটির স্পষ্ট কোন কারন এখন বের করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান পাহাড়ঘেঁষা শহর থেকে দূরে এমন এক স্থানে যেখানে গ্রাম আর বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানা মাখামাখি। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় আর গ্রামের সীমানার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। ফলে গ্রামের মানুষের সাথে শিক্ষার্থীদের হরহামেশাই সাক্ষাৎ ঘটে থাকে। গ্রামবাসী শিক্ষার্থীদের আচরনে যে খুব একটা সন্তুষ্ট নয় এ ঘটনাই ত্রা প্রমাণ। হতাশার কথা হলো শুধু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ই নয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া প্রায় প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানাই এভাবে গ্রামের সাথে লাগোয়া। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আলাদা সীমানা নেই বললেই চলে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কোন দ্বীপ রাষ্ট্র নয় যে একেবারে গ্রাম থেকে আলাদা সীমানায় রাখতে হবে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা বলে কথা। নিরাপত্তার খাতিরেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানা আলাদা করে নিরাপত্তা বেষ্টনী দেয়া দরকার। আর এখন যেহেতু গ্রামের সাথে সীমানা রয়েছে সেহেতু গ্রামবাসীর সাথে ভালো সম্পর্কেও বিষয়টি গুরুত্বপূর্ন।

যদি বলা হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হত্যাকান্ডগুলো আশেপাশের এলাকার মানুষের ক্ষোভের বহিপ্রকাশ, তা কিন্তু মেনে নেয়ার মত নয়। গ্রামবাসীর সাথে বিরোধ থাকতেই পারে কিংবা গ্রামবাসী শিক্ষার্থীদের আচরনে নাখোশ হতেই পারেন, তাই বলে এভাবে সিরিজ হত্যাকান্ড ঘটাবেন এমনটা বিশ্বাস করাটা কষ্টেরই বটে। তবে অন্যান্য কারনগুলোর সাথে এ কারনটিকে একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায়না।
সাম্প্রতিক সময়ে ক্যাম্পাসে সহিংসতার মাত্রা কতটা বেড়েছে তা প্রত্যেকদিনের সংবাদপত্রই সাক্ষী। কিছুদিন আগেও শিক্ষার্থী সহিংসতার জেরে অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ হয়ে যায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার্থীদের নিজস্ব দ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, টেন্ডারবাজি চাঁদাবাজির দ্বন্দ্ব, আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্ব ইত্যাদি নানা দ্বন্দ্ব আর সংঘাতে অস্থির শিক্ষাঙ্গন।
শিক্ষাঙ্গনের এসব অস্থিরতার বলি হয়েছে অনেক শিক্ষার্থী। ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা যেমন খুন হয়েছে তেমনি আহতও হয়েছে অনেক। বারবার অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ হয়েছে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ব্যাহত হয়েছে প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রম।
গনমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী গত ১৫ মাসে শিক্ষাঙ্গনগুলোতে প্রায় পনেরশ সংঘর্ষেও ঘটনা ঘটেছে। মানুষ গড়ার আঙ্গিনা পরিনত হয়েছে মানুষ মারার আঙ্গিনা হিসেবে। মেধাবী শিক্ষার্থীরা মননের চর্চার বদলে চর্চা করছে হননের। এ ফলে দিনদিনই প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে আমাদেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। কয়েকদিন পরপরই যখন আমরা শুনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বর‌্যাংকিংয়ে পাঁচ হাজারের উপরে কিংবা দিনদিন আরো পিছিয়ে পড়ছে। সে সংবাদ আমাদের হতাশাচিত্তে গলধকরণ ছাড়া কিছুই করার থতাকেনা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আসাদ খুন হলো কেন? ঘটনা প্রবাহে প্রত্যক্ষ কারন যেটা দেখা যাচ্ছে, সূচনাটা পহেলা বৈশাখ। পহেলা বৈশাখে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরতে আসা নিকটস্থ গ্রামের নব দম্পতিকে লাঞ্চিত করার ঘটনা হলো মূল ইস্যু ( এখনও সর্বশেষ তথ্যমতে, তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে, তাদের রিপোর্ট পাওয়া পর্য›ত প্রকৃত সত্যের জন্য অপেক্ষা করতে হবে) । পরদিন ১৫ এপ্রিল আসাদ এবং তার সহপাঠীদের স্টেশনে আড্ডারত অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পরিচয় পেয়ে জোবরা গ্রামের সন্ত্রাসীরা তাদের উপর আক্রমন করে।পহেলা বৈশাখে যে শিক্ষার্থীরাই ঘটনাটা ঘটিয়ে থাকুক, আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় সে ঘটনাই আসাদেও মৃত্যু ও তার সহপাঠীদের আহত হওয়ার কারণ।

এসব ঘটনার মাধ্যমে প্রমাণ করে শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধের ভয়াবহ রকমের অবক্ষয় ঘটেছে। শুধু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাটাই নয়, ঠিক পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের ঘটনাও তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় পহেলা বৈশাখ আসে কালো আর জীর্নতা থেকে পৃথিবীকে পবিত্র করতে। এবারের পহেলা বৈশাখ ছিলো তার উল্টো। ১৫ জন তরুণী পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে লাঞ্চিত হয়েছে। পরদিন সংবাদপত্রগুলোতে বৈশাখের ভালো খবর ছাপিয়ে প্রাধাণ্য পেয়েছে তরুণীদের লাঞ্চিত হওয়ার সংবাদটি। শিক্ষার্থীদের হাতে তরুণীদের লাঞ্চিত হওয়ার বিষয়টি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কতটা বেদনা দায়ক তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।

আজকে শুধু শিক্ষাঙ্গনের শিক্ষার্থীদেরই মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছে বিষয়টি তা নয়। গোটা দেশব্যাপি এ অবক্ষয় স্পষ্ট। বখাটেপনার শিকার হয়ে ছাত্রীদের আতœহত্যা, নিয়মিত ধর্ষন আর যৌন হয়রানির ঘটনাগুলো তারই উদাহরণ। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধেও উঠছে যৌন হয়রানির অভিযোগ।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আসাদ হত্যাকান্ডকে যে যেভাবেই বলুক, এটাতো ঠিক এ আসাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের মত একটি সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থী। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছে পড়াশোনা করতে। সে পড়াশোনা করে চাকরি করবে। দুঃখী পরিবারের দুঃখ ঘুচাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটি শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রেই এটা সত্য। সেখানে যদি শিক্ষার্থী নিহত হয়, পরিবারগুলো কিভাবে তার সন্তানের হত্যাক্ান্ড মেনে নেবে। সন্তানের খুন হওয়া একজন মাতা পিতার জন্য কতটা কষ্টের তা ভূক্তভোগিরাই ভালো জানেন।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী হত্যার এ ট্রেন্ড অনেক আগ থেকেই চলে আসছে। সববিশ্ববিদ্যালয়েই কমবেশী অনেক শিক্ষার্থী খুন হেেয়ছে। এসব হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে যে বিষয়টি আলোচনায় চলে আসে সেটি হলো ক্যাম্পাস নিরাপত্তা। যদি শিক্ষাঙ্গন বা ক্যাম্পাস এ জীবনের নিরাপত্তাই না থাকে সেখানে পড়াশোনা আর গবেষনার চিন্তা করাটাও অমূলক। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদ হত্যার পর যেটা দেখা গেছে, অনেক শিক্ষার্থীই নিরাপত্তার অভাবে বাড়ি চলে গেছে। যারা হলে অবস্থান করছে তারাও ভয়ে বাইরে বের হচ্ছেনা। মেয়েরাতো আরো ভয়ে আছে। এখন চবির গোটা ক্যাম্পাসেই বিরাজ করছে ভীত বিহবলতা।
ক্যাম্পাসের এ নিরাপত্তার হুমকি আমাদের গোটা শিক্ষাব্যস্থার জন্যই একটা চ্যালেণজ। এর প্রভাব হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। এ নিরাপত্তার স্বার্থে প্রত্যেকটি ক্যাম্পাসে সংগঠিত ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত এবং বিচার হওয়া প্রয়োজন্। এ তদন্তের মাধ্যমে একটি ঘটনার ও যদি সুষ্ঠু কারণ শনাক্ত করা যায় বা সে ঘটনার সাথে কারা জড়িত সেটার গডফাদারই বা কে তবে হয়তো প্রত্যেকটি ঘটনা আমাদের কাছে স্পষ্ট হতো।
ইদানিং সংবাদপত্রগুলো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় একটা গ্রুপের সন্ধান পেয়েছে। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা অপকর্মের জন্য বিভিন্ন সময়ে বহিস্কার হয়েছে। তারাই সেখানে এখনও নানা অপরাধ করছে। এভাবে প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়েই একটা না একটা অপরাধী চক্র সক্রিয় রয়েছে। এছাড়া যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সীমানা গ্রামের সাথে রয়েছে সেখানে গ্রাম বাসীর সাথে ভালো আচরণ করার বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানা আলাদা করে নিরাপত্তা বেষ্টণীর কথাতো আগেই বলা হলো।
ক্যাম্পাস নিরাপত্তায় রাজনৈতিক কমিটমেন্টটা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ক্যাম্পাসে যত সংঘর্ষ বা আহত নিহতের ঘটনাই ঘটেছে অধিকাংশই ঘটেছে রাজনৈতিক কারনে। বিশেষ ছাত্ররাজনীতির নামে এখন ঘটছে সংঘর্ষ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আসাদের মত এভাবে হত্যাকান্ড চলতে দেয়া যায়না। যারাই এ হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে তাদের খুজে বের করে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। ভবিষ্যতে এসব হত্যাকান্ড আর যাতে না ঘটে সে ব্যাপারে সরকারসহ প্রশাসনের অধিক সতর্কতা তৎকাম্য।

শনিবার, এপ্রিল ১৭, ২০১০

প্রাথমিক শিক্ষার পুনর্বিন্যাস (যায়যায়িদন ১৪ এিপ্রল ২০১০)




প্রাথমিক শিক্ষার পুনর্বিন্যাস
বিগত নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগের ইশতিহারে শিক্ষা বিষয়টি আসে গুরুত্বের সঙ্গে। ইশতিহারে শিক্ষার প্রথম দু/তিনটি লাইন-মানব সম্পদ উন্নয়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শিক্ষা, বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তি খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেয়া হবে। এ লক্ষ্যে যুগোপযোগী নতুন শিক্ষা নীতি প্রণয়ন করা হবে। ইশতিহারের ওয়াদা অনুযায়ী ক্ষমতা গ্রহণ করেই শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের কাজে হাত দেয় সরকার। জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে সভাপতি করে ১৮ সদস্যের শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন কমিটি গঠিত হয়। কমিটির প্রথম সভা হয় ৩ মে ২০০৯; ১৯৭৪ সালের কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন এবং; ১৯৯৭ সালের শামসুল হক শিক্ষা কমিটির প্রতিবেদনের আলোকে এ কমিটি একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে। ২ সেপ্টেম্বর এর কাজ শেষ হয়। ৭ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কাছে খসড়া শিক্ষানীতি জমা দেয়া হয়।
মাহফুজুর রহমান মানিক

এ শিক্ষানীতির প্রধান দিক হলো কাঠামোর পরিবর্তন। উচ্চ মাধ্যমিককে বাদ দিয়ে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এ তিন স্তরে শিক্ষাকে সাজানো হয়। অবশ্য এর বাইরে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থাও এখানে রয়েছে। সেটা প্রাথমিক শিক্ষার আগের স্তর। প্রাথমিক শিক্ষা প্রথম শ্রেণী থেকে অষ্টম পর্যন্ত মাধ্যমিক শিক্ষা নবম, দশম, একাদশ এবং দ্বাদশ শ্রেণী। এর পরের স্তর উচ্চ শিক্ষা।
এবারের শিক্ষানীতির আলোকে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে আমার এ সামনের প্রয়াস। খসড়া শিক্ষানীতির ২৯টি অধ্যায়ের মধ্যে দ্বিতীয় অধ্যায়টি প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে। শিক্ষানীতির মোট ৯৬ পৃষ্ঠার মধ্যে ৯-১৬ পৃষ্ঠায় বর্ণিত হয়েছে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা।
প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাটি কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনেও ছিল। সেখানে এর বাস্তবায়নের জন্য শিশু ভবন ও শিশু উদ্যান নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। শিশু ভবন জন্ম থেকে ৩ বছর পর্যন্ত শিশুদের জন্য এবং শিশু উদ্যান ৩ থেকে ৫ বছর পর্যন্ত শিশুদের জন্য।
এবারের শিক্ষানীতিতে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাটি দেখানো হয়েছে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার মানসিক ও দৈহিক প্রস্তুতি হিসেবে। যেখানে ৫+ বয়সী শিশুরা ভর্তি হবে। থাকবে আকর্ষণীয় উপকরণ আর শিশুর মনের বিকাশের যাবতীয় ব্যবস্থা। সঙ্গে সঙ্গে নিজ ধর্মের ধর্মীয় উপাসনালয়ে ধর্মীয় শিক্ষার বিষয়টিও এসেছে।
প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা শহরে চালু করা যতো সহজ হবে গ্রামের ক্ষেত্রে ততোটা সহজ হবে না। শহরে বিদ্যমান প্রাইভেট স্কুলগুলোয় প্রথম শ্রেণীর আগেই তিনটি শ্রেণী রয়েছে। প্লে, নার্সারি, কেজি ইত্যাদি নামে রয়েছে। এখানে আড়াই থেকে ৩ বছর বয়সী শিশুরা স্কুলে যায়।
শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক শিক্ষাকে বলা হয়েছে সব শিক্ষার ভিত্তি। জাতীয় জীবনে এর গুরুত্ব অত্যধিক। এটি হবে সর্বজনীন বাধ্যতামূলক এবং অবৈতনিক। এ স্তরের দায়িত্ব সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রের। সংবিধানের ১৭ নং অনুচ্ছেদটি প্রণিধানযোগ্য-
রাষ্ট্র
ক. একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য,
খ. সমাজের প্রয়োজনের সহিত শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করিবার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করিবার
উদ্দেশে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছা প্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য,
গ. আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করিবার জন্য,
কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।
সংবিধানের এ বিধানের আলোকে প্রাথমিক শিক্ষাকে এ শিক্ষানীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া হয়েছে। বিদ্যমান বিভিন্ন ধারার মধ্যে একটি সুসমন্বয়ের চেষ্টা করা হয়। শিক্ষানীতি প্রবর্তনের সময় বা এর আগে একমুখী শিক্ষার যে তোড়জোড় শোনা গিয়েছিল, সে গর্জনের বর্ষণটা সেভাবে হয়নি। শিক্ষানীতিতে মাদ্রাসার কথা এলেও ইংরেজি মাধ্যমের প্রতিষ্ঠানের কথা আসেনি।
২০১১-২০১২ সালের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষায় ১০০ ভাগ শিক্ষার্থী ভর্তির কথা বলা হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষার স্তরকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বাড়ানোর বিষয়টি যেমন আন্তর্জাতিক শিক্ষার সঙ্গে মিল রয়েছে, তেমনি প্রাথমিক শিক্ষার পর কেউ না পড়লেও যাতে কিছু করে খেতে পারে সে ব্যবস্থাও রয়েছে। এজন্য প্রাথমিকের ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বৃত্তিমূলক শিক্ষার বিষয়টি এসেছে।
শিক্ষক শিক্ষার্থীর একটি সুষম অনুপাতের কথা বলেছে। ১ঃ৩০। ঝরে পড়া রোধে চমৎকার কিছু সুপারিশ রয়েছে এ নীতিতে। শিক্ষার্থী উপবৃত্তি, দুপুরে খাবারের ব্যবস্থা, স্কুল পরিবেশকে আনন্দদায়ক করে তোলা ইত্যাদি। আদিবাসী, প্রতিবন্ধী ও বঞ্চিত শিশুদের কথাও বাদ পড়েনি।


শিক্ষণ পদ্ধতি ও পরীক্ষা পদ্ধতিতে শিশু উপযোগী চিন্তা প্রতিফলিত হয়েছে। আমাদের শহরের শিশুরা যেখানে জন্মের পর থেকেই পরীক্ষার জ্বরে আক্রান্ত, সেখানে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি পরীক্ষা বাতিল। এবং প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে বিদ্যমান কাঠামোগত পরীক্ষা পদ্ধতি বাতিলের সুপারিশ শিশুবান্ধব শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত করবে।
শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত যোগ্যতা চাওয়া হয়েছে এইচইসসি/মাধ্যমিক পাস। শিক্ষানীতিতে উল্লিখিত শব্দ এইচইসসি দ্বারা কি বোঝানো হয়েছে? যদি শব্দটি এসএসসি ধরি তাহলে তার সঙ্গে যুক্ত মাধ্যমিক কথাটি বিদ্যমান শিক্ষা স্তর অনুযায়ী ঠিক আছে। তবে এ যোগ্যতা কিছুটা কম বলেই আমার কাছে মনে হয়। অবশ্য যদি এইচএসসি ধরি তার সঙ্গে মাধ্যমিক কথাটি প্রস্তাবিত শিক্ষা স্তর অনুযায়ী ঠিক আছে।
এতে অনেকের বক্তব্য এ নীতি বাস্তবায়ন হলে প্রাথমিক শিক্ষকরা চাকরি হারাবেন তা ঠিক নয়। কারণ তারা শুধু আগের মতোই পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াবেন। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত নতুন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হবে।
প্রাথমিক শিক্ষার যা কিছু প্রয়োজন সব সুপারিশ এ নীতিতে রয়েছে। নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরির সম্ভাব্য খরচও দেখানো হয়েছে। এখন বাকি এটি চূড়ান্ত করা আর বাস্তবায়ন। এক্ষেত্রে জনগণ বা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের মতামতকে গ্রহণ করে এটি চূড়ান্ত করা দরকার। বাস্তবায়নের রোডম্যাপ ২০১৮ সাল পর্যন্ত দেয়া হয়েছে। এতো লম্বা সময়ের কোনো অবকাশ নেই। যতো দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়নের কাজে হাত দেয়া উচিত। বিগত প্রতিবেদনগুলোর মতো হিমাগারে এটি যাবে না বলেই আমাদের বিশ্বাস।
প্রাথমিক শিক্ষা সরকারের চ্যালেঞ্জ। দেশের সার্বিক শিক্ষা এ সত্যর ওপরই নির্ভর করে। এ চ্যালেঞ্জের উপরই নির্ভর করে সামনের দিনের সফলতা আর ব্যর্থতা। ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন এ শিক্ষার দ্বারাই বাস্তবায়ন হবে। এ শিক্ষানীতি সে পথেই নিয়ে যাবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

রবিবার, এপ্রিল ১১, ২০১০

Energy security (Sunday, April 11, 2010_Daily star)















Energy security

Mahfuzur Rahman Manik, Student of IER, SM Hall, Dhaka University
Bangladesh is passing through a crucial time with its energy crisis. The energy security is threatened here. With power gas and water crisis people are suffering most. Load shedding is very much regular. In 24 hours of time, electricity/power is available for 7-9 hours and it also varies from place to place. The newspapers have published detailed reports on load shedding. This Energy security has obstructed our agriculture and industrial production. On 30 March, a newspaper reported that due to the energy crisis our industrial production has declined by 30 percent. It has also reduced national investment.
It is time for irrigation for Boro cultivation. For irrigation of land, the demand of power/electricity is higher than what it was last year. The government set a plan to produce one crore and eighty-seven lakh metric tons of Boro paddy from 48 lakh hectors of land. To cultivate this land, around 2.5 lakh pumps are necessary. The pumps need one thousand and six hundred megawatts of electricity. At present our power production is four thousand and two hundred megawatt. Every day the shortage is eighteen hundred megawatts, so we suffer the heavy load shedding.
To make up for the extra power recently the government took up the rental power project. Power rented from a neighbouring country will be added to the national greed, but the production cost of this project is very high. Whereas a general plant needs Tk 2/3 lakh per unit, this project cost is more than five times higher. Why did the government take up this costly project?
To solve the power problem, the government has promised that power generation will be raised to five thousand megawatts within 2011. But the plan appears to be highly ambitious, given the ground reality.
Rental plant is not the solution to our power crisis.

বুধবার, এপ্রিল ০৭, ২০১০

পঞ্চম নয় অষ্টম শ্রেণীই সমাপনী পরীক্ষার সর্বোত্তম সময় ( যায়যায়িদন ৭ এিপ্রল২০১০)





পঞ্চম নয় অষ্টম শ্রেণীই সমাপনী পরীক্ষার সর্বোত্তম সময়
মাহফুজুর রহমান মানিক

পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষা আরম্ভ হলো গত বছর। সবাই এর ভালো দিকই তুলে ধরেছেন। জাতীয় পর্যায়ের একেকটি পরীক্ষা জীবনের একেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। সে ধাপে আমরা আমাদের শিশুদেরকে ১০/১১ বছরেই ঠেলে দিচ্ছি। যুদ্ধ যাকে বলে। গত বছরের মাঝামাঝি থকেই প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা হওয়ার জল্পনা কল্পনা চলছিলো। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে লেগে যায় সেপ্টেম্বর মাস। সেপ্টেম্বরের সাত তারিখের ঘোষণায় প্রাথমিক শিক্ষার সমাপনী পরীক্ষা নিশ্চিত হয় এবং শিক্ষার্থীরা তখন থেকে প্রস্তুতি নেয়। ২১ নভেম্বর শুরু হয় পরীক্ষা। সকাল বিকাল অর্থাৎ একদিন দুই বিষয় করে পরীক্ষা হয়। একদিন দুই বিষয় করে পরীক্ষা নেয়ার প্রয়োজন কী ছিলো? মানলাম সরকার প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা না নিয়ে তার পরিপূরক হিসেবেও এ পরীক্ষা নিচ্ছে। তাই বলে আগের বৃত্তি পরীক্ষার আদলে সকাল বিকাল পরীক্ষা নেওয়ার তো কোনো প্রয়োজন ছিলো না। একেতো ঘোষণাই হয়েছে দেরিতে, মাত্র দুইমাস আগে, তারওপর আবার দিনে দুই বিষয়ের পরীক্ষা। অবশ্য এসব কারণ থাকা সত্তেও শিশুরা যে পরীক্ষায় ভালো করেছে, তা ফলাফল দেখলেই বোঝা যায়। পরীক্ষা শেষ হওয়ার একমাসের মাথায়ই শিক্ষার্থীরা পেয়ে যায় তাদের কাঙ্খিত ফলাফল। মোট প্রায় ২০ লাখ শিক্ষার্থী এ পরীক্ষার জন্য রেজিষ্ট্রেশন করলেও অংশগ্রহণ করে ১৮ লাখ ২৩ হাজার ৪৬৫ জন। অর্থাৎ পরীক্ষার আগেই একটা অংশ ঝরে পড়লো। এরপর অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে পাশ করে মোট ১৬ লাখ ২০ হাজার ৫৪ জন। পাশের হার ৮৮.৮৪ ভাগ। যদিও এর মধ্যে গনিত ও ইংরেজীতে সর্বোচ্চ ১৩ নাম্বার গ্রেস দিয়ে আরো ৭ ভাগ শিক্ষার্থীকে পাশ করানো হয়। পাশের হার ৮৯ ভাগ ধরলেও এখানে ঝরে পড়েছে ১১ ভাগ শিক্ষার্থী। পাশ করা শিক্ষার্থীদের প্রথম বিভাগ পেয়েছে ৬ লাখ ৬৭ হাজার ৭১৭ জন। দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছে ৬ লাখ ১৫ হাজার ও তৃতীয় বিভাগ পেয়েছে ২৭ হাজার জন। অর্থাৎ ৪১.৭৭ পেয়েছে প্রথম বিভাগ, ৩৭.৯৮ ভাগ পেয়েছে দ্বিতীয় এবং ২০.২৫ ভাগ পেয়েছে তৃতীয় বিভাগ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হিসেবে ৩৭ হাজার ২২৫ টি প্রতিষ্ঠানের সবাই পাশ করেছে‌। আর ১ হাজার ৯৩৭ টি প্রতিষ্ঠানের কোন শিক্ষার্থীই পাশ করতে পারেনি। প্রাথমিক শিক্ষায় ১১টি ধারা থাকলেও দুঃখজনক হলেও সত্য তার অন্যতম ধারা মাদরাসার শিক্ষার্থীরা গত বছরের সমাপনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেনি। কর্তৃপক্ষ নাকি তাদের কথা ভুলে গেছে। এ বছর থেকে অবশ্য তাদেরকে অন্তর্ভূক্ত করা হবে। ফলে এবছর মাদরাসা পড়ুয়া কোনো শিক্ষার্থী এ সাধারণ ধারার ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হতে পারছেনা। যাই হোক সার্বিক বিবেচনায় প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা সফল সরকার ৫০ হাজার শিক্ষার্থীকে ফলাফলের উপর ভিত্তি করে বৃত্তি দেবে। বেশ ভালো কথা। প্রাথমিক স্তরের সমাপনী পরীক্ষা চালু করার বিষয়ে কিছু যুক্তি দেখানো হয়েছে, ঝরে পড়ার হার কমানো, এনরোলমেন্ট বাড়ানো, আলাদাভাবে বৃত্তি ব্যবস্থা বাদ দেয়া ইত্যাদি। ঠিকই আছে, কিন্তু তাই বলে এস এস সি'র মতো দেশব্যাপী পাবলিক পরীক্ষার বোঝা শিশুদের মাথায় দেওয়া কতটা কল্যাণের। কম টাকার মধ্যে ফরম পুরণ করা গেছে ঠিক আগে। এ পদ্ধতির খারাপ দিক ও আছে। একটি দশ এগারো বছরের শিশুকে এভাবে পাবলিক পরীক্ষার দিকে ঠেলে দেওয়া মানে তার মাথায় একটা বোঝা চাপিয়ে দেয়া, যা বহন করতে সে সক্ষম নয়। এ বোঝা হলো পড়ার বোঝা। তার এবং তার অভিভাবকের মাথায় শুধু পাশ করার চিন্তা। ফলে শিশুর ধারণ ক্ষমতার বাইরের সময়ে তাকে পড়তে হবে। গত বছর দেখা গেছে অনেক অভিভাবকই আর সন্তানকে রাত ১২টা পর্যন্ত পড়িয়েছেন রাজধানীর ভর্তি যুদ্ধেও তাই হয়। ফলে এবার দেখা গেছে ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসে পরীক্ষার হলেই ঘুমিয়ে পড়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীতে ফলাফলের যে বিন্যাস তা ও শিশুসুলভ নয়। প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বিভাগ এ ভর্তির ফলাফল দেয়া হয়েছে। যে শিশু প্রথম বিভাগ পায়নি, তার মানে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগ পাওয়ার বেদনা থাকতে পারে, যা তাকে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকেই কুকড়ে খাবে। সাথে সাথে আজীবন তাকে তৃতীয় শ্রেণীর সার্টিফিকেট নিয়ে থাকতে হবে। এরাতো পাশ করলো বলা যায়, কিন্তু যারা পরীক্ষায় পাসই করেনি তারা তো ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হতে পারছেনা। সে কী করবে? আরেকবার পরীক্ষা দেয়ার প্রেষণা সে কোথা থেকে পাবে। যেখানে তার সব সাথীরা তার উপরের শ্রেণীতে পড়ছে। এদেরকে পরবর্তী ধাপে ফিরিয়ে আনা যে কষ্ট হবে তা বলা যায়। দরিদ্র পিতামাতার পুনরায় পরীক্ষায় অংশ দিতে দেওয়ার প্রেষণা ফুরিয়ে যাবে। এবার যদিও ১১ভাগ শিশু পাশ করেনি, একটা বিরাট অংশ এ পরীক্ষায়ই অংশ নেয়নি। এদের জন্য সমাপনী পরীক্ষা কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণই বয়ে আনবে। এবার আসা যাক ৮ম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষার বিষয়ে। যাকে বলা যায় জুনিয়র এসএসসি। কিছুদিন হল সরকার এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখানে ও বৃত্তি পরীক্ষার বিষয়টিকে বড় করে দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ ৮ম শ্রেণীর বৃত্তি পরীক্ষা না হয়ে একেবারে সমাপনী পরীক্ষা। ৫ম শ্রেণীর চেয়ে ৮ম শ্রেণীর এ সমাপনী পরীক্ষাই যুক্তিযুক্ত। ৮ম শ্রেণীকে আমরা শিক্ষার একটা ধাপ বলতে পারি। শিক্ষার্থীদের বয়স ও কিছুটা বোঝার ১৩-১৪বছর। এ বয়সে তাদেরকে পাবলিক পরীক্ষার সম্মুখীন করাই যায়। অন্যদিকে এ স্তর অধিক উপযুক্ত, কারণ এবারের শিক্ষানীতিতে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা করার সুপারিশ করা হয়েছে ।শিক্ষানীতির এ প্রস্তাবনা চূড়ান্ত হলে আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা হবে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত। তখন প্রাথমিক স্তরের সমাপনী পরীক্ষা হিসেবে জাতীয় পর্যায়ে এসএসসির মত এ পরীক্ষা নেওয়া যায়। যার সার্টিফিকেট ও জীবনের সর্বস্তরে কাজে লাগানো যাবে। এখন যেমন সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন চাকরিতে ৮ম শ্রেণী পাশ করা প্রার্থী চাওয়া হয়। সে ক্ষেত্রে এ পরীক্ষা বৈধ সার্টিফিকেট প্রার্থী দেখাতে পারবে। এখন দেখা যায় অনেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা না করে ও যেকোন প্রতিষ্ঠান থেকে পাশের নকল সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে নকল শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রমাণ দেখায়। এবারের শিক্ষানীতিতে ৬ষ্ঠ শ্রেণীর পর থেকে কারিগরি ভোকেশনাল তথা বাস্তবমুখী পাঠ্যপুস্তকের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা যথোপযুক্ত। প্রথম শ্রেণী হতে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত আট বছরের শিক্ষা জীবনের অর্জিত যেন তার জীবনের অর্জন হয়। অর্থাৎ ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েও সে যাতে তার পরবর্তী জীবন সুন্দরভাবে পরিচালনা করতে পারে সেটি নিশ্চিত করা। ঠিক যে কারণে প্রাথমিক শিক্ষাকে ৫ম থেকে বাড়িয়ে ৮ম শ্রেণী করার প্রস্তাবনা এসেছে ,একই কারণে ৮ম শ্রেণী শেষে সমাপনী পরীক্ষা নেওয়া দরকার। সরকার একই সিলেবাসের কথা বলেছে। ৮ম শ্রেণী সমাপনী পরীক্ষায় একই সিলেবাস হলে মাদ্রাসা যাবে কোথায়? তাহলে কি গতবারের ৫ম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষার মতো অষ্টম শ্রেণীতে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের বঞ্ছিত করা হবে। অভিন্ন সিলেবাসের কথা যদি সকল ধারার সিলেবাস মত হতো। এবছর মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভুক্ত করতে মাদ্রাসা এবং স্কুলে দুই সিলেবাসে পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে। অবশ্য এ ব্যাপারে মাত্র সিদ্ধান্ত হয়েছে। তা বাস্তবায়নের জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে সভাপতি করে যে কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদের সুপারিশ দেখা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এখন থেকে ৫ম ও ৮ম শ্রেণী তথা উভয় স্তরে পরীক্ষা না নিয়ে কেবল ৮ম শ্রেণীতে সমাপনী নিলেই হয়। এতে এক দিকে শিক্ষার্থীও কল্যাণ অন্যদিকে নতুন শিক্ষানীতির সাথেও মিলানো যাবে।

বিদ্যুত সংকেট গণদুের্ভাগ (সাপ্তািহক প্রিতিচত্র ২ এিপ্রল২০১০)





বিদ্যুত সংকেট গণদুের্ভাগ

মাহফুজুর রহমান মানিক
ভয়াবহ বিদ্যুত সংকটে দেশ। লোডশেডিংয়ের নাকালে মানুষের ভোগান্তি চরমে। জনজীবনের অস্থিরতার পাশাপাশি কমছে উৎপাদন। বোরো মৌসুম চলছে, সেখানে ব্যাহত হচ্ছে সেচ কাজ, এইচ এস সি পরীক্ষার্থীরা বিপাকে। গার্মেন্টসসহ সকল শিল্পের উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সর্বোপরি এ সংকট আমাদের বিনিয়োগেও ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। এবার ৪৮ লাখ হেক্টর জমিতে এককোটি ৮৭ লাখ মেট্রিকটন বোরো ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হয়। এর জন্য বিদ্যুৎ মন্ত্রনালয়ের তথ্য মতে, ২লাখ ৫৯ হাজার ৪৪টি সেচ পাম্প চালাতে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ প্রয়োজন ১ হাজার ৬৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। সব মিলিয়ে এখন বিদ্যুতের চাহিদা ৬ হাজার মেগাওয়াটের ওপরে। উৎপাদন পিডিবির মতে, সর্বোচ্চ ৪ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। ঘাটতি মেটাতে সরকার রেন্টাল বা ভাড়ায় চালিত বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নিয়েছিলো। বিদেশ থেকে বিদ্যুৎ কেন্দ্র ভাড়া এনে এ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ইউনিট প্রতি ২টাকার স্থলে খরচ হবে ১২-১৩ টাকা। অথচ এ প্রকল্পে উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমান মাত্র ২৬৫ মেগাওয়াট মাত্র। আর এ রেন্টাল বিদ্যুত দিয়ে কৃষক এবার উপকৃত হতে পারছেনা। কারন মে জুন মাসে এগুলোর সুফল পাওয়া যেতে পারে। এ অল্প পরিমান বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকার অনেক টাকা অযথাই গচ্ছা দিচ্ছে বলে বিশেষঞ্জদেও ধারনা। বিদ্যুত ঘাটতি মেটাতে সরকার ২০১১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন ৫ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করার কথা বলেছে। কীভাবে করবে গ্যাস দিয়ে? অথচ গ্যাস সংকটই এখন বিদ্যুৎ সমস্যার প্রধান কারন। এখন বাংলাদেশের অধিকাংশ বিদ্যুৎ কেন্দ্রই গ্যাস ভিত্তিক। বর্তমানে ১৯টি গ্যাস ক্ষেত্রের ৭৯টি কূপ থেকে গ্যাস উৎপাদিত হচ্ছে। এসব গ্যাস ক্ষেত্রের উৎপাদন ক্ষমতা পেট্রোবাংলার মতে, দুই হাজার মিলিয়ন ঘটফুট। শিল্প কারখানা, বেসরকারি, সরকারি, গৃহস্থালি, বিদ্যুত উৎপাদনসহ নানা কাজে গ্যাসের চাহিদা ৩ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। গ্যাসের ঘাটতি এতে প্রতিদিন ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। গ্যাসের এ ঘাটতি থাকতে আবার গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র কতটা যৌক্তিক। কারন কিছুদিন আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গ্যাসের নিরাপত্তার গ্যারান্টি ছাড়াই সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১২০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্লান্টের একটি ইউনিট উদ্বোধন করেন। সেখানে গ্যাস স্বল্পতার কারনে পরদিনই উৎপাদন ৫০ মেগাওয়াটে নেমে আসে। এমনিতেই এখন চট্টগ্রামের গ্যাসের অভাবে রাউজানে ২১০ মেগাওয়াটের ২টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং ৫৬ ও ৬০ মেগাওয়াটের দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র শিকলবাহায় বন্ধ আছে। এছাড়া গ্যাস সংকটে অনেক কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও কমে গেছে। বিদ্যুাতের এ পরিস্থিতির কারনে রাজধানি ঢাকা সহ গোটা দেশেই ব্যাপক ভাবে বেড়েছে লোডশেডিং। গ্যাস সংকট তো আছেই সাথে সাথে দেখা দিয়েছে পানি সংকট। গ্যাস, পানি এবং বিদ্যুৎ সমস্যায় অস্থির জনজীবন। তারওপর চৈত্রের প্রচন্ড দাবদাহ। গরম আস্তে আস্তে আরো বাড়ছে। সুতরাং ভোগান্তিও শেষ নেই। আমাদেও এ সমস্যা জাতীয় অসচেতনতার জন্যও তৈরি হয়েছে। বিদ্যতের জন্য বাংলাদেশ গ্লোবাল এনভায়রনমেন্টাল ফান্ড থেকে বঞ্চিত হয়েছে । এ তহবিল থেকে যে পরিমান অর্থ পাওয়া যেত বিশেষজ্ঞদের ধারনা যে ফান্ড দিয়ে ৭০০ মেগাওয়াট পরিবেশ বান্ধব বিদ্যুত ঊৎপাদন করা যেত। বিষয়টি হলো ১৯৯৬ সালে পাওয়ার সেল নবায়ন যোগ্য জ্বালানীর একটি নীতিমালা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। সেটা অনুমোদিত হয় ১২ বছর পর ২০০৮ সালে সময়মতো এ নীতি বা¯তবায়ন হলে জিইএফ এর অর্থ পাওয়া যেত। যা দিয়ে ২৫০ মেগাওয়াট উইন্ড পাওয়ার সহ ১৫০ মেগাওয়াট সোলার বায়োগ্যাস থেকে ১৫০ মেগাওয়াট ও কো-জেনারেশন থেকে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত পাওয়া যেত। অথাৎ ৭০০ মেগাওয়াট ফ্রি বিদ্যুত আমরা হারিয়েছি।বিদ্যমান বিদ্যুৎ সংকট নিরসনে গত বছর সরকার ডেলাইট সেভিং টাইম চালু করেছিলো যা জনগনের কাছে ডিজিটাল টাইম হিসেবে পরিচিতি। এমাসের ৩১ তারিখ থেকে আবার সেটি চালুর পরিকল্পনা সরকারের ছিল। কিন্তু জনগন, বিশেজ্ঞসহ নানাজনের রাঁধায় সেটি আর চালু হচ্ছে না। বা¯তবে দরকার ও নেই। কারণ গতবছরের অভিজ্ঞতায়ই তার অসারতা প্রমান হয়েছে। সরকার (সিএফ এল) তথা কম্প্যাক্ট ফ্লুরোসেন্ট লাইট বাল্বের কথা বলেছে। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে এ বাল্ব কিছুটা হলেও ভূমিকা পালন করবে, সেটা যদি জনগনের কাছে পৌছানো হয়। ২ কোটি ৬৫ লাখ সিএফএল বাল্ব বিতরন করলে ৩৫০ মেগাওয়াট বিদ্যূত সাশ্রয় হতো। সরকার সে পরিকল্পনা করলেও এখনও বাস্তবায়ন করেনি। বর্তমান বিদ্যুত কেন্দ্র গুলোর যন্ত্রপাতি মেরামত এবং পুরনো বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর প্রয়োজনীয় সংস্কার করে উৎপাদন কিছুটা বাড়ানো সম্ভব। গ্যাস সংকটে নতুন ক্ষেত্র অনুসন্ধান করে বঙ্গোপসাগর সহ সম্ভাবনাময় বিভিন্নস্থানে একাজ করা যেতে পারে। গ্যাসের উপর নির্ভর না থেকে কয়লার উপর নির্ভরতা বাড়ানো প্রয়োজন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বে ৫৮ শ মিলিয়ন টন কয়লা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর মধ্যে ৭৫% ব্যবহৃত হয় বিদ্যুৎ উৎপাদন। চীন ভারত সহ পৃথিবীর অনেক দেশই কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে খুব ভালোভাবেই। এজন্য আমাদের একটি সুষ্ঠু কয়লানীতি হওয়া আবশ্যক। দেশে এখনও কয়লনীতি চূড়াšত হয়নি। বলা হয় বাংলাদেশে ২০০/৩০০ কোটি মেট্রিকটন কয়লা মজুদ রয়েছে। যা দিয়ে অনায়াসেই দেশের বিদ্যুৎ সংকট মেটানো সম্ভব। কিন্তু আমাদের পরিকল্পনার অভাবে সে কাজ ভালোভাবে এগুচ্ছেনা । সুষ্ঠু কয়লা নীতিমালা করে দ্রুত আমাদের এ জ্বালানি সম্পদকে রক্ষা করা দরকার।বিদ্যুতের বিষয়ে ব্যক্তিগত উৎপাদন পদ্ধতিতে জনগনকে উৎসাহ দেয়া প্রয়োজন। এলাকা ভিত্তিক প্লান্ট স্থাপন, সেটা হতে পারে রিয়েল এষ্টেট কোম্পানী গুলোর এলাকা ভিত্তিক, কিংবা পৌরসভা সিটি কর্পোরেশন এলাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদন। এগুলোকে পরে জাতীয় গ্রীডের সাথেও যুক্ত করা যায়।বিদ্যুৎ উৎপাদনে রেন্টাল প্রক্রিয়া কিংবা কোম্পানির হাতে ছেড়ে দেয়া কোন সমাধান নয়। বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় উৎপাদন, বিতরন, সরবরাহ এতো বিভাজন না রেখে এ গুলোকে এক সংস্থায় করে দেখা যেতে পারে।বিদ্যুত উৎপাদনে গ্যাস কয়লা এগুলো অনবায়নযোগ্য শক্তি। এগুলোর মজুদ ও আমাদের বেশি না। ইতিমধ্যেই গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে। আমাদের গ্যাস সম্পদ যা মজুদ আছে তা দিয়ে হয়তো কয়েক বছর চলবে। এরপর যে সংকট আসছে তা অত্যাšত ভয়াবহ। বিশ্বব্যাপী এ জ্বালানী সংকট ঘনীভুত হচ্ছে। এগুলোর প্রতি আমাদের নির্ভরতা এখনি না কমালে, দেশের বিপদ অত্যাসন্ন। এজন্য তেল গ্যাস কয়লার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করে এর বাইরের জ্বালানি সম্পদের দিকে নজর দেয়া অত্যšত জরুরি। এর বাইরে রিনিউয়েবল এনার্জি তথা নবায়নযোগ্য শক্তিই রয়েছে বিকল্প। এ শক্তির মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন যেমন সহজসাধ্য, তেমনি কম খরচ এবং পর্যাপ্তও। এ শক্তি কখনো নিঃশেষ হবে না। অবশ্য এ নবায়নযোগ্য শক্তি দিয়ে যে আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজ যে শুরু হয়নি তা নয়। নবায়নযোগ্য শক্তি সমূহ হলো সৌরশক্তি, বায়ু প্রবাহ শক্তি, জলবিদ্যুৎ শক্তি, হাইড্রোজেন শক্তি, এছাড়া আরেকটি হতে পারে পারমানবিক বিদ্যুৎ শক্তি। বিকল্প শক্তি হিসেবে বাংলাদেশে জৈব গ্যাস প্রযুক্তি ও সম্ভাবনার। জলবিদ্যুৎ শক্তি ব্যবহার করে দেশের কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প চালু আছে। এখানে ৭টি ইউনিটের মোট উৎপাদন ক্ষমতা ২৩০ মেগাওয়াট। জল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অšতর্ভূক্ত হিসেবে জোয়ার ভাটা কেন্দ্রিক বা তরঙ্গ বিদ্যুৎ পদ্ধতির কথাও বলা যায়। এসব পদ্ধতিতে ফ্রান্স, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, নরওয়ে প্রভৃতি দেশ সমূহ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে থাকে। বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরকে কাজে লাগিয়ে তরঙ্গ শক্তির বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করার সম্ভাবনা রয়েছে। সৌরশক্তির ব্যবহার ও আমাদের দেশে বাড়ছে। সূর্যের রশ্মি থেকে আহরিত শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বর্তমানে দেশে প্রতিদিন ১৫ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। এবং এ শক্তি ব্যবহার করে প্রায় ৮ লাখ বাড়ি আলোকিত হচ্ছে। এ পদ্ধতি প্রধানত গ্রীড লাইন থেকে দূরবর্তী গ্রামীণ এলাকা সমুহ এবং চা বাগান গুলোতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। অথচ এ পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন আমাদের জন্য সহজ ও সুলভ। বিজ্ঞানীরা বলেছেন সূর্য এক বছরে পৃথিবীতে যে শক্তি সরবরাহ করে তা বিশ্বের পারমানবিক ফসিল জ্বালানি তথা কয়লা তেল, গ্যাস ইত্যাদির মিলিত শক্তির তুলনায় পনের হাজারগুন বেশি। হাইড্রোজেন শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন আমাদের দেশে শুরু না হলেও বায়ু প্রবাহ শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষুদ্র প্রয়াসে হলেও শুরু হয়েছে। এরমধ্যে গ্রামীন শক্তির কক্সবাজারের চকোরিয়া চিংড়ি খামারের স্থাপনা এবং ব্রাকের বিভিন্ন উপকূলী এলাকায় ১১টি টারবাইন স্থাপন অন্যতম। পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের কথা আওয়ামীলীগের ইশতিহারে রয়েছে। রূপপুরের এ পারমানবিক কেন্দ্রের ব্যাপারে চীন ও রাশিয়ার আগ্রহ আছে।ু সরকার সে আলোচনা নিশ্চয়ই চালিয়ে যাচ্ছে। তবে এ পদ্ধতি অত্যšত ব্যয়বহুল এবং পরিবেশের জন্য ও ঝুঁকিপূর্ন। এজন্য অনেকে একে স্বপ্নবিলাস বললে ও পত্রিকায় আমরা পড়েছি ইতিমধ্যে তা নিয়ে কথা শুরু হয়েছে।বিকল্প জ্বালানির কথা বললে জৈব গ্যাস প্রযুক্তিও সম্ভাবনাময়ী খাত। ১৯৯৬ গবাদি পশুছিল ২কোটি ৫১ লাখ ৯০ হাজার। এগুলো থেকে যদি প্রতিদিন ২৪ কোটি পশু বর্জ্য উৎপন্ন হয়। সে বর্জ্য দিয়ে প্রতিদিন অনেক জৈব গ্যাস উৎপাদন সম্ভব। এখন গবাদিপশুর পরিমান প্রায় ৫কোটি সুতরাং বলাই যায় এটা সম্ভব নয় ক্ষেত্র। এসব বিকল্প এবং সম্ভাবনাময় দিকগুলোকে কাজে লাগিয়ে ভালোভাবে উদ্যোগ নিলে, সরকার ২০১৪ সালের মধ্যে দেশকে যে লোডশেডিংমুক্ত দেশ গড়ার কথা বলেছে তা সম্ভব হতে পারে। তখন উন্নত বিশ্বেও মতো আমাদেও ডিকশনারিতেও লোডশেডিং নামে কোন শব্দ থাকবেনা। ২০১৪ না হলেও ২০২১ সালে ও কী আমরা সে স্বপ্ন দেখবো না?

রবিবার, এপ্রিল ০৪, ২০১০

জ্বালানি নিরাপত্তা : সংকট ও সম্ভাবনা (দৈনিক ডেসটিনিতে প্রকাশিত ১ এপ্রিল২০১০)





জ্বালানি নিরাপত্তা : সংকট ও সম্ভাবনা

সংবাদপত্রগুলো যখন শিরোনাম করছে-‘দু:সহ নগর জীবন’ কিংবা-‘বিদ্যুত গ্যাস পানি তিন সমস্যায় রাজধানি’, তখন বিদ্যুত প্রতিমন্ত্রীর আহবান-‘কৃষকদের কথা ভেবে নগরবাসিকে ধৈর্য্য ধরতে হবে’। বাস্তবতা হলো সেদিনই (২৪ মার্চ) চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নড়াইল, বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুতের জন্য বিক্ষোভ করেছে কৃষকরা, সংশ্লিষ্ট বিদ্যুত অফিস ভাংচুর করেছে। এর আগের সংবাদ হলো সিরাজগঞ্জে লোভোল্টেজের কারনে পুড়ে গেছে শতাধিক মোটর, বিদ্যুত সমস্যায় বরিশালে বোরো আবাদ হুমকিতে , টাঙ্গাইল, ঝালকাঠি, কুমিল্লাসহ গোটা দেশের বোরো আবাদের অবস্থা একই রকম। বিদ্যুত নেই। এ বোরোর মওসুমে কৃষকদের নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুত দেয়ার অঙ্গীকার করেছিলো সরকার। অথচ কৃষকরা দিনেতো বিদ্যুত পানইনা আর রাত ১১ টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুত দেয়ার কথা থাকলেও , এ সময়ে বিদ্যুত থাকে মাত্র ২ ঘন্টা। এতে গোটা দেশেই বোরোর আবাদ হুমকিতে, বোরো চাষে মনযোগ দেয়ার কথা থাকলেও কৃষক এখন বিদ্যুতের আন্দোলনে রাস্তায়।শহরগুলোতে লোডশেডিং তীব্র, বিদ্যুত প্রতিমন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রী ও কর্তা ব্যক্তিরা বলছেন সেচ কাজের জন্য বিদ্যুত মিলছেনা শহর গুলোতে। এখন শহরেও বিদ্যুত নেই আর সেচ কাজের অবস্থা বা কৃষকদের অবস্থাও এই। এ চিত্রটা একজন কার্টুনিস্ট (সাপ্তাহিক বুধবার ১৭ মার্চ) চমৎকার এঁকেছেন, আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় এক জন, তার দুইপাশে দুইটা মুখ, একপাশে কৃষক আরেক পাশে শ্রমিক। কৃষক কাঁচি নিয়ে বিদ্যুতের জন্য বিক্ষোভ করছে। তাকে বলছেন, শিল্প উৎপাদনের কথা ভেবে একটু ধৈর্য্য ধরুন। অন্য পাশের শ্রমিক মোমবাতি নিয়ে বিদ্যুৎ চাচ্ছে। তাকে বলছেন; কৃষি উৎপাদনের কথা ভেবে একটু ধৈর্য্য ধরুন। কার্টুনের বা¯তব চিত্রই আমরা দেখছি। মূল সমস্যা বিদ্যুৎ। প্রয়োজনে বিদ্যুৎ নেই। কারণ বিদ্যুতের উৎপাদন কম। কৃষকদের বোরো চাষ গরম মৌসুম অন্যান্য কাজে এখন বিদ্যুাতের চাহিদা সাড়ে পাঁচ হাজার থেকে ছয় হাজার মেগাওয়াট, বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে ৩ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট হতে ৪ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। ফলে বিদ্যুৎ ঘাটতি পনেরশ হতে দুই হাজার মেগাওয়াট। ঘাটতি পনেরশ কিংবা দুই হাজার মেগাওয়াট হলে ও বর্তমান ভয়াবহ লোডশেডিং এ মনে হয় আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন ২ হাজার মেগাওয়াটের উর্ধে নয়। কৃষকের বোরো চাষের জন্য এ মৌসুমে বিদ্যুতের বাড়তি চাহিদার কথা সকলের জানা। সরকার আগ থেকেই কৃষকদের আশ্বাস দিচ্ছে, এ মৌসুমে বিদ্যুতের কোন সংকট হবে না, অšতত বোরো চাষের কোন ক্ষতি হবে না। বা¯তবতা হলো সরকারের এ আশ্বাস কৃষকের সাথে প্রতারণা বৈ কিছু নয়। এবার ৪৮ লাখ হেক্টর জমিতে এককোটি ৮৭ লাখ মেট্রিকটন বোরো ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হয়। এর জন্য ২লাখ ৫৯ হাজার ৪৪টি সেচ পাম্প (বিদ্যুৎ মন্ত্রনালয়ের তথ্য মতে) চালাতে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ প্রয়োজন ১ হাজার ৬৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। সব মিলিয়ে এখন বিদ্যুতের চাহিদা ৬ হাজার মেগাওয়াটের ওপরে। উৎপাদন সর্বোচ্চ ৪ হাজার ২০০ (পিডিবির মতে) মেগাওয়াট। ঘাটতি মেটাতে সরকার রেন্টাল বা ভাড়ায় চালিত বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নিয়েছিলো। ব্যয় বহুল ফার্নেস তেল এবং ডিজেলে চালিত ৮টি রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের টেন্ডার আহবান করে। আটটি কেন্দ্রের পাঁচটি কেন্দ্রের দরপত্র মন্ত্রি সভার ২৩ ডিসেম্বরের বৈঠকে অনুমোদন পায়। তিনটি কেন্দ্রের চুক্তি পিডিবি ৪ ফেব্রুয়ারি মাত্র সম্পন্ন করে। এগুলো হলো নোয়াপাড়া, উৎপাদন ক্ষমতা ১০৫ মেগাওয়াট, ঠাকুর গাঁও ৫০ মেগাওয়াট এবং ভেড়ামারা ১১০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন। এগুলো থেকে বিদ্যুত আসতে ন্যূনতম চার মাস সময় লাগবে। অথচ এখনি বোরোর সর্বোৎকৃষ্ট সময়। আগামী মাসেই বোরোর মৌসুম শেষ হচ্ছে। কৃষকের জন্য এ রেন্টাল বা ভাড়ায় চালিত প্রকল্প গুলো হাতে নিলেও কৃষকরা এখান থেকে উপকৃত হতে পারছে না। এ রেন্টাল পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন অত্যšত ব্যয়বহুল। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতিহারে এ রেন্টাল পদ্ধতির কথা না থাকলেও আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, সরকারের কৃষকদের বিদ্যুত চাহিদা মেটানোর জন্য এ পদ্ধতি গ্রহণ করে বাহবা কুড়ানো ছাড়া অন্যকোন উদ্দেশ্য নেই। অবশ্য সেটাও ভে¯েত গেছে। এটি কৃষকের সাথে সরকারের স্পষ্ট প্রহসন। কৃষকরাতো এতে লাভবান হচ্ছেনইনা অন্যদিকে এ বিদ্যুৎ উৎপাদকেরা অতিরিক্ত দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করে ব্যাপক মুনাফা লাভ করবে। সরকার অযথাই এখানে হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিবে। জনগনের টাকা সরকারের দিতে কী।রেন্টাল পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ ঘাটতির বিষয়টি ১৯৯৬ সালে প্রথম আলোচনায় আসে। তখন বা¯তবায়ন না হলে ও এখন সেটার বা¯তবায়ন হচ্ছে। বিদেশ থেকে বিদ্যুৎ কেন্দ্র ভাড়া এনে এ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ইউনিট প্রতি ২টাকার স্থলে খরচ হবে ১২-১৩ টাকা। অথচ এ প্রকল্পে উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমান মাত্র ২৬৫ মেগাওয়াট মাত্র, এ অল্প পরিমান বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকার এতো টাকা গচ্ছা দিচ্ছে কেন তা কারোর কাছেই স্পষ্ট নয়।সরকার ২০১১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন ৫ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করার কথা বলেছে। কীভাবে করবে গ্যাস দিয়ে? সরকারের গত এক বছরের কার্যকলাপে সেটাই মনে হচ্ছে। অথচ গ্যাস সংকটই এখন বিদ্যুৎ সমস্যার প্রধান কারন। এখন বাংলাদেশের অধিকাংশ বিদ্যুৎ কেন্দ্রই গ্যাস ভিত্তিক। বর্তমানে ১৯টি গ্যাস ক্ষেত্রের ৭৯টি কূপ থেকে গ্যাস উৎপাদিত হচ্ছে। এসব গ্যাস ক্ষেত্রের উৎপাদন ক্ষমতা দুই হাজার মিলিয়ন (পেট্রোবাংলার মতে) ঘটফুট। শিল্প কারখানা, বেসরকারি, সরকারি, গৃহস্থালি, বিদ্যুত উৎপাদনসহ নানা কাজে গ্যাসের চাহিদা ৩ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। গ্যাসের ঘাটতি এতে প্রতিদিন ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। গ্যাসের এ ঘাটতি থাকতে গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে অর্থহীন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গ্যাসের নিরাপত্তার গ্যারান্টি ছাড়াই সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১২০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্লান্টের একটি ইউনিট উদ্বোধন করেন। সেখানে গ্যাস স্বল্পতার কারনে পরদিনই উৎপাদন ৫০ মেগাওয়াটে নেমে আসে। সরকারের দাবি, তারা এ প্রকল্পটি সহ এ সময়ের মধ্যেই জাতীয় গ্রীডে ৫৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছে। অথচ গ্যাস চালিত হলে ও এসব প্রকল্পের কাজ আগ থেকেই শুরু হয়, সরকার শুধু উদ্বোধন করেছে মাত্র। সরকার গ্যাস ভিত্তিক আরো দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি করে। চাঁদপুর ও সিলেট ১৫০ মেগাওয়াট করে মোট ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের চুক্তিই বিশেষজ্ঞদের কাছে বর্তমান সরকারের সরকারিখাতে নতুন কোন বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের প্রথম চুক্তি। গ্যাস রেশনিং, গ্যাসের জন্য সিএনজি ষ্টেশনের অলস বসে থাকা কিংবা গৃহিনীরা যেখানে রান্না করতে গ্যাস পাচ্ছে না। সেখানে গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র কতটা নির্ভরশীল সেটাই ভাবার বিষয়। এমনিতেই এখন চট্টগ্রামের গ্যাসের অভাবে রাউজানে ২১০ মেগাওয়াটের ২টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং ৫৬ ও ৬০ মেগাওয়াটের দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র শিকলবাহায় বন্ধ আছে। এছাড়া গ্যাস সংকটে অনেক কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও কমে গেছে। বিদ্যুাতের এ পরিস্থিতির কারনে রাজধানি ঢাকা সহ গোটা দেশেই ব্যাপক ভাবে বেড়েছে লোডশেডিং। গ্যাস সংকট তো আছেই সাথে সাথে দেখা দিয়েছে পানি সংকট। গ্যাস, পানি এবং বিদ্যুৎ সমস্যায় অস্থির জনজীবন। তারওপর চৈত্রের প্রচন্ড দাবদাহ। গনমাধ্যম গুলো এনিয়ে কয়েকদিন ধরেই প্রতিবেদন দিচ্ছে । কেউ বলছে ‘অসহ্য লোডশেডিং’ কারো ভাষায় ‘এক ঘন্টা বিদ্যুৎ এক ঘন্টা লোডশেডিং ২৪ ঘন্টা ভোগাšিত’ কারো শিরোনাম ‘বিদ্যুতের মিসড কল’ কিংবা ‘সারাদেশে বিদ্যুৎ সংকট’। বিদ্যুতের এসব যাওয়া আসা আর ভোগাšিতর অবসান হবেনা যতদিন না স্থায়ী কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়। সদিচ্ছার কারোই অভাব থাকে না কিংবা অঙ্গীকার করতে কেউ কম করেননা। কিন্তু কর্মে সেটা ফলে না, এর অন্যতম কারন দূর্নীতি। ১৯৮৮ সাল থেকে এরশাদ আমলে শুরু হওয়া দুর্নীতির ভূত মাঝখানের হাসিনা খালেদার সরকার এমনকি তত্ত্বাবধায়ক সরকারকেও ছাড়েনি। প্রত্যেকের আমলেই বিদ্যুতের নামে কয়েক হাজার কোটি টাকার দূর্নীতি হয়েছে। এসব টাকা বিদ্যুত খাতে ঠিকভাবে খাটালে আজ আমাদের এতো সংকটও থাকতোনা।এ দূর্নীতির ফলে আরেকটা কাজ হয়েছে, বাংলাদেশ ২০০৮ সালে বিশাল এক ফান্ড থেকে বঞ্চিত হয়। গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফান্ড বা জিইএফ নামের এ তহবিল থেকে যে পরিমান অর্থ পাওয়া যেত বিশেষজ্ঞদের ধারনা যে ফান্ড দিয়ে ৭০০ মেগাওয়াট পরিবেশ বান্ধব বিদ্যুত ঊৎপাদন করা যেত। বিষয়টি হলো ১৯৯৬ সালে পাওয়ার সেল নবায়ন যোগ্য জ্বালানীর একটি নীতিমালা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। সেটা অনুমোদিত হয় ১২ বছর পর ২০০৮ সালে সময়মতো এ নীতি বা¯তবায়ন হলে জিইএফ এর অর্থ পাওয়া যেত। যা দিয়ে ২৫০ মেগাওয়াট উইন্ড পাওয়ার সহ ১৫০ মেগাওয়াট সোলার বায়োগ্যাস থেকে ১৫০ মেগাওয়াট ও কো-জেনারেশন থেকে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত পাওয়া যেত।বিদ্যুৎ সমস্যার অন্যতম কারণ হলো বিশ্বব্যাংক আইএমএফ সহ বিদেশিদের প্রেসক্রিপশন গ্রহণ। বিদ্যুতের রেন্টাল পদ্ধতিও এদেরই অন্যতম এজেন্ডা। লক্ষ্য হলো বিদেশী কোম্পানী গুলোর মুনাফা নিশ্চিত করা। এরা বিদ্যুৎ খাতে সংস্কারের নামে সরাকারি প্রতিষ্ঠান (পিডিবি) ভেঙ্গে কোম্পানি করার পরামর্শ দেয়। ফলে হয়েছে ডেসা, ডেস্কো, পল্লী বিদ্যুত, ডিপিডিসি ইত্যাদি। সরকারি প্রতিষ্ঠানের বাইরে এগুলো থেকে সরকার চড়া দামে বিদ্যুৎ ক্রয় করে জনগনকে অল্প দামে দিচ্ছে। এতে সরকারের ক্ষতি হচেছ হাজার হাজার কোটি টাকা। অথচ সরকার যদি এ টাকা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে না দিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করতো। এতে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান হতো। ইতিমধ্যে সরকার বিদ্যুাতের দাম একদফা বাড়িয়েছে ৪ থেকে ৭ ভাগ, বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে কার্যত কিছুই হয়নি। বিদ্যুত সমস্যাতো বেড়েছেই কার্যত মোটা অংকের লাভ করছে কোম্পানিগুলো। এ প্রসঙ্গে একটু বলে রাখি, বাংলাদেশ ব্যাংকের চেয়ারম্যান জনাব আতিউর রহমানকে ধন্যবাদ কারণ তিনি সম্প্রতি (২৪.০৩.০১) আইএমএফ এর দেয়া ঋনের প্র¯তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংক ঋণদেয় শর্তে সেটা হলো তাদের ফর্মূলা অনুসারে বা¯তবায়ন। অতীতে বিদ্যুৎসহ সব কাজে তাদের ফর্মুলার অনুসরন করা হয়েছে, তাদের আনীত প্রেসক্রিপশনের বাইরে দেশের স্বার্থে কথা বলার মত যোগ্য মানুষ খুবই কম। এক্ষেত্রে তাদের ফর্মুলা বা¯তবায়নে আমাদের কী ক্ষতি, কিভাবে গ্রহণ করলে আমাদের লাভ, সে ব্যাপারে দরকষাকষি করার মত যোগ্য মানুষের ভীষন প্রয়োজন। আতিউর রহমান যদি তার সূচনা করেন নিশ্চয়ই সেটা দেশের জন্য সুখবর।বিদ্যমান বিদ্যুৎ সংকট নিরসনে গত বছর সরকার ডেলাইট সেভিং টাইম চালু করেছিলো যা জনগনের কাছে ডিজিটাল টাইম হিসেবে পরিচিতি। এমাসের ৩১ তারিখ থেকে আবার সেটি চালুর পরিকল্পনা সরকারের ছিল। কিন্তু জনগন, বিশেজ্ঞসহ নানাজনের রাঁধায় সেটি আর চালু হচ্ছে না। বা¯তবে দরকার ও নেই। কারণ গতবছরের অভিজ্ঞতায়ই তার অসারতা প্রমান হয়েছে। সরকার (সিএফ এল) তথা কম্প্যাক্ট ফ্লুরোসেন্ট লাইট বাল্বের কথা বলেছে। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে এ বাল্ব কিছুটা হলেও ভূমিকা পালন করবে, সেটা যদি জনগনের কাছে পৌছানো হয়। বর্তমান বিদ্যুত কেন্দ্র গুলোর যন্ত্রপাতি মেরামত এবং পুরনো বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর প্রয়োজনীয় সংস্কার করে উৎপাদন কিছুটা বাড়ানো সম্ভব। গ্যাস সংকটে নতুন ক্ষেত্র অনুসন্ধান করে বঙ্গোপসাগর সহ সম্ভাবনাময় বিভিন্নস্থানে একাজ করা যেতে পারে। গ্যাসের উপর নির্ভর না থেকে কয়লার উপর নির্ভরতা বাড়ানো প্রয়োজন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বে ৫৮ শ মিলিয়ন টন কয়লা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর মধ্যে ৭৫% ব্যবহৃত হয় বিদ্যুৎ উৎপাদন। চীন ভারত সহ পৃথিবীর অনেক দেশই কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে খুব ভালোভাবেই। এজন্য আমাদের একটি সুষ্ঠু কয়লানীতি হওয়া আবশ্যক। দেশে এখনও কয়লনীতি চূড়াšত হয়নি। লেখাটা যখন লিখছি তখনও (২৫.০৩.১০) দেশের প্রথম ও চালু থাকা একমাত্র কয়লাখনি দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিতে চলছে শ্রমিক আন্দোলন। উৎপাদনের বদলে সেখানে বিরাজ করছে অস্থিরতা। শ্রমিকদের বেতন না বাড়নোর কারনে এ আন্দোলন। বলা হয় বাংলাদেশে ২০০/৩০০ কোটি মেট্রিকটন কয়লা মজুদ রয়েছে। যা দিয়ে অনায়াসেই দেশের বিদ্যুৎ সংকট মেটানো সম্ভব। কিন্তু আমাদের পরিকল্পনার অভাবে সে কাজ ভালোভাবে এগুচ্ছেনা । সুষ্ঠু কয়লা নীতিমালা করে দ্রুত আমাদের এ জ্বালানি সম্পদকে রক্ষা করা দরকার।বিদ্যুতের বিষয়ে ব্যক্তিগত উৎপাদন পদ্ধতিতে জনগনকে উৎসাহ দেয়া প্রয়োজন। এলাকা ভিত্তিক প্লান্ট স্থাপন, সেটা হতে পারে রিয়েল এষ্টেট কোম্পানী গুলোর এলাকা ভিত্তিক, কিংবা পৌরসভা সিটি কর্পোরেশন এলাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদন। এগুলোকে পরে জাতীয় গ্রীডের সাথেও যুক্ত করা যায়।বিদ্যুৎ উৎপাদনে রেন্টাল প্রক্রিয়া কিংবা কোম্পানির হাতে ছেড়ে দেয়া কোন সমাধান নয়। ইতিমধ্যে এখাতে বিদেশি কোম্পানিকে হাজার হাজার কোটি টাকা সরকার ভর্তুকি দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। এটা কখনো লাভজনক কিছু না। বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় উৎপাদন, বিতরন, সরবরাহ এতো বিভাজন না রেখে এ গুলোকে এক সংস্থায় করে দেখা যেতে পারে।গ্যাস কয়লা এগুলো অনবায়নযোগ্য শক্তি। এগুলোর মজুদ ও আমাদের বেশি না। ইতিমধ্যেই গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে। আমাদের গ্যাস সম্পদ যা মজুদ আছে তা দিয়ে হয়তো কয়েক বছর চলবে। এরপর যে সংকট আসছে তা অত্যাšত ভয়াবহ। বিশ্বব্যাপী এ জ্বালানী সংকট ঘনীভুত হচ্ছে। এগুলোর প্রতি আমাদের নির্ভরতা এখনি না কমালে, দেশের বিপদ অত্যাসন্ন। এজন্য তেল গ্যাস কয়লার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করে এর বাইরের জ্বালানি সম্পদের দিকে নজর দেয়া অত্যšত জরুরি। এর বাইরে রিনিউয়েবল এনার্জি তথা নবায়নযোগ্য শক্তিই রয়েছে বিকল্প। এ শক্তির মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন যেমন সহজসাধ্য, তেমনি কম খরচ এবং পর্যাপ্তও। এ শক্তি কখনো নিঃশেষ হবে না। অবশ্য এ নবায়নযোগ্য শক্তি দিয়ে যে আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজ যে শুরু হয়নি তা নয়। নবায়নযোগ্য শক্তি সমূহ হলো সৌরশক্তি, বায়ু প্রবাহ শক্তি, জলবিদ্যুৎ শক্তি, হাইড্রোজেন শক্তি, এছাড়া আরেকটি হতে পারে পারমানবিক বিদ্যুৎ শক্তি। বিকল্প শক্তি হিসেবে বাংলাদেশে জৈব গ্যাস প্রযুক্তি ও সম্ভাবনার। জলবিদ্যুৎ শক্তি ব্যবহার করে দেশের কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প চালু আছে। এখানে ৭টি ইউনিটের মোট উৎপাদন ক্ষমতা ২৩০ মেগাওয়াট। জল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অšতর্ভূক্ত হিসেবে জোয়ার ভাটা কেন্দ্রিক বা তরঙ্গ বিদ্যুৎ পদ্ধতির কথাও বলা যায়। এসব পদ্ধতিতে ফ্রান্স, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, নরওয়ে প্রভৃতি দেশ সমূহ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে থাকে। বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরকে কাজে লাগিয়ে তরঙ্গ শক্তির বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করার সম্ভাবনা রয়েছে। সৌরশক্তির ব্যবহার ও আমাদের দেশে বাড়ছে। সূর্যের রশ্মি থেকে আহরিত শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বর্তমানে দেশে প্রতিদিন ১৫ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। এবং এ শক্তি ব্যবহার করে প্রায় ৮ লাখ বাড়ি আলোকিত হচ্ছে। এ পদ্ধতি প্রধানত গ্রীড লাইন থেকে দূরবর্তী গ্রামীণ এলাকা সমুহ এবং চা বাগান গুলোতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। অথচ এ পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন আমাদের জন্য সহজ ও সুলভ। বিজ্ঞানীরা বলেছেন সূর্য এক বছরে পৃথিবীতে যে শক্তি সরবরাহ করে তা বিশ্বের পারমানবিক ফসিল জ্বালানি তথা কয়লা তেল, গ্যাস ইত্যাদির মিলিত শক্তির তুলনায় পনের হাজারগুন বেশি। হাইড্রোজেন শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন আমাদের দেশে শুরু না হলেও বায়ু প্রবাহ শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষুদ্র প্রয়াসে হলেও শুরু হয়েছে। এরমধ্যে গ্রামীন শক্তির কক্সবাজারের চকোরিয়া চিংড়ি খামারের স্থাপনা এবং ব্রাকের বিভিন্ন উপকূলী এলাকায় ১১টি টারবাইন স্থাপন অন্যতম। পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের কথা আওয়ামীলীগের ইশতিহারে রয়েছে। রূপপুরের এ পারমানবিক কেন্দ্রের ব্যাপারে চীন ও রাশিয়ার আগ্রহ আছে।ু সরকার সে আলোচনা নিশ্চয়ই চালিয়ে যাচ্ছে। তবে এ পদ্ধতি অত্যšত ব্যয়বহুল এবং পরিবেশের জন্য ও ঝুঁকিপূর্ন। এজন্য অনেকে একে স্বপ্নবিলাস বললে ও ২০১৭ সাল পর্যšত হয়তো আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। বিকল্প জ্বালানির কথা বললে জৈব গ্যাস প্রযুক্তিও সম্ভাবনাময়ী খাত। ১৯৯৬ গবাদি পশুছিল ২কোটি ৫১ লাখ ৯০ হাজার। এগুলো থেকে যদি প্রতিদিন ২৪ কোটি পশু বর্জ্য উৎপন্ন হয়। সে বর্জ্য দিয়ে প্রতিদিন অনেক জৈব গ্যাস উৎপাদন সম্ভব। এখন গবাদিপশুর পরিমান প্রায় ৫কোটি সুতরাং বলাই যায় এটা সম্ভব নয় ক্ষেত্র। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর আমাদের দেশে সম্ভাবনার কমতি নেই। এসব সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের সম্পদে রূপাšতরিত করার মত জনসম্পদ আর দেশপ্রেমিক নাগরিকের অভাব রয়েছে। এসব কিছুকে কাজে না লাগালে আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ, সম্ভাবনার বাংলাদেশ বিদ্যুৎ বিহীন ঘরের মত অন্ধকারেই থেকে যাবে। তখন ডিজিটিাল বাংলাশের শ্লোগান অধরাই থেকে যাবে।

পানি, গণবিস্ফোরন ও সরকার ( দৈিনক ডেসটিনি ৭ এপ্রিল ২০১০)

পানি, গণবিস্ফোরন ও সরকার
মাহফুজুর রহমান মানিক


সম্প্রতি (৩১ মার্চ) ঢাকার সংসদ সদস্যরা পানি সংকট নিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। পানি সংকটের তীব্রতায় রাজধানি বাসির ােভ গণবিস্ফোরনে রূপ নিতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেছেন খোদ সরকারদলীয় এ সংসদ সদস্যরা। ঢাকা ও নারায়নগঞ্জ তথা ওয়াসার আওতাধীন এলাকার জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে এমন সময়ে এ বৈঠক যখন বিভিন্ন এলাকায় পানির দাবিতে বিােভ করছেন গ্রাহকরা। রাজধানির সর্বত্র পানির তীব্র সংকটে অতিষ্ঠ নগরবাসি। এমনকি পানির এ সংকট উপস্থিত সংসদ সদস্যদের ও ছাড়েনি। তেজগাঁও-রমনা থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য যিনি বিগত ৫০ বছরে তার বাড়িতে পানির অভাব দেখেননি, কিন্তু এবার তিনদিন ধরে তার বাড়িতে পানি নেই।


এমনিতেই বিদ্যুত নেই, গ্যাস সমস্যা তারওপর পানির এ সংকট। সবমিলিয়ে রাজধানি বাসি কতটা ফুঁেস উঠছে, যার পরিনতি হতে পারে গনবিস্ফোরন, এসব ভেবেই এ বৈঠকটি। গন প্রতিনিধিরা তাদের এলাকার সংকট দ্রুত মেটাতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন। বৈঠকটির গুরুত্ব উপলব্ধি করতে কষ্ট না হলেও সরকার কতো দ্রুত এর সমাধান করতে পারবে। কারন রাজধানির এ পানি সমস্যার বাস্তব কারনতো রয়েছেই সাতে রয়েছে মনুষ্য বা আমাদের তৈরি কারন।
চাইলেই রাতারাতি এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। তবুও প্রয়োজনীয় পদপে নিতে সরকার নিশ্চয়ই গড়িমসি করবেনা।

রাজধানি ঢাকা। বিশ্বের অন্যতম মেগাসিটি। জনসংখ্যা যে যাই বলুক ১ কোটি ২০ লাখের নিচে নয়। এ প্রায সোয়া কোটি জনসংখ্যার প্রতিদিন পানির চাহিদা ২৩৫ কোটি লিটার। নগরবাসির পানির দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা ওয়াসা।ওয়াসার তথ্যমতে, ঢাকায় প্রতি বছর মানুষ বাড়ে পাঁচ লাখ। এ বর্ধিত মানুষের জন্য পানি প্রয়োজন ১০ কোটি লিটার। গতবছর রাজধানিতে পানির চাহিদা ছিলো ২২৫ কোটি লিটার। এবার সেটা বেড়ে হয় ২৩৫ কোটি লির্টা । চাহিদা ২৩৫ কোটি লিটার হলেও এ পরিমান পানি সরবরাহ করতে ব্যর্থ ঢাকা ওয়াসা। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী ওয়াসা ১৯৪ কোটি লিটার পারি সরবরাহ করতে পারে। এতে ওয়াসার হিসেব ধরলেও ঘাটতি ৪১ কোটি লিটার। আপাত দৃষ্টিতে ঘাটতি ৪১ কোটি লিটার হলেও বর্তমানে নানাকারনে ঘাটতির পরিমান বলা চলে সরবরাহের অর্ধেক। বিদ্যমান বিদ্যুত সমস্যাই এ ঘাটতিকে ত্বরান্বিত করেছে।

এখন না হয় বিদ্যুতকে দায়ী করা যায় অর্থাত বিদ্যুতের তীব্র লোডশেডিং এর কারন পানি উত্তোলন ও সরবরাহ কম। কিন্তু উত্তোলিত পানি অপচয় হওয়ার বিষয়টি কিভাবে মেনে নেয়া যায়। ৩ এপ্রিল প্রকাশিত একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদন অনুসারে , ঢাকা ওয়াসার ৩০ শতাংম পানিই অপচয় হয়। এমনিতেই চাহিদার তুলনায় উত্তোলন কম এরপরও ৩০ শতাংশ অর্থাৎ ৫৮ কোটি লিটার পানি অপচয় হয়। এতে নাগরিকরা কতোটা পানি পাচ্ছে এবং তাদের ভোগান্তি কতটা চরমে তা সহজেই অনুমেয়।
প্রত্যেকদিনই কোননা কোন এলাকার বাসিন্দা পানির দাবিতে রাস্তায় নামছে। অন্যদিকে ওয়াসার গাড়ির পানি বা বাইরের ট্যাবের পানির জন্য দীর্ঘ লাইণ আর কাড়াকাড়ি চুলাচুলির ঘটনাও নেহায়েত কম ঘটছেনা। এভাবে গণবিােভ থেকে গনবিস্ফোরনের আশংকা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায়না।

নগরবাসি নিয়মিত খাবারের, গোসলের পানি পাচ্ছেনা। অনেক এলাকায় ৩/৪
দিন একসপ্তাহ এমনকি ১৫ ধরেও পানি নেই। পানির পথপানে চেয়ে থাকতে থাকতে নগরবাসি অভ্যস্ত। এরপরও প্রতিতি পানি পেলেও সে পানি খাবারতো দুরে থাক ব্যবহারেরই অযোগ্য। পুতি দুর্গন্ধময় আর ঘোলা রংয়ের পানি ফুটিয়ে ব্যবহার করাও দায়। এর কারন নদী হতে উত্তোলিত এবং গভীর ণলক’প হতে উত্তোলিত পানির লাইনের আন্ত:সংযোগ।

ঢাকা ওয়াসা দূভাবে পানি উত্তোলন করে, নলক’প হতে এবং নদী হতে। এর মধ্যে নদীর পানি মাত্র ১৩ ভাগ আর বাকী ৮৭ ভাগ পানিই নলক’পের পানি। নলক’প হতে উত্তোলিত পানি দূষিত বা দূর্গন্ধ হওয়ার কথা না। এরপরও এ অবস্থা কারন নদী আর নলক’পের পানি সরবরাহের অভিন্ন লাইন। ঢাকার নদী দূষনের চিত্র কতটা ভয়াবহ তা কারো অজানা নয়। ওয়াসার নদী হতে উত্তোলিত ১৩ ভাগ পানির ১০ ভাগ শীতল্যার আর বাকী ৩ ভাগ পানি মাত্র বুড়িগঙ্গার। এ দু নদীর তেরো ভাগ পানিই ওয়াসার পুরো পানিকে দূষিত কওে ফেলৈ।

শোধনাগার দিয়ে নদীর পানি দূষনমুক্ত করলেও পানির অত্যধিক দূষনের কারনে তা শোধনেরও অযোগ্য। অবশ্য ওয়াসার পানির দূর্গন্ধ বা দূষিতের জন্য একমাত্র নদীর পানিই দায়ি নয। এর সাথে পানি সরবরাহকৃত পাইপলাইনও সমভঅবে দায়ি। নগীরর বেশিরভাগ পাইপলাইনই অনেক পুরনো। অনেক পাইপে জংধরে ফুটো হয়ে গেছে। ফুটো দিযে যেকোন ময়লা পাইপে ঢুকে পড়ে। ফলে দূষিত হয় পানি।

নদীর পানি দুষিত হলেও গভীর নলক’পের মাধ্যমে পানি উত্তোলনের ফলে আরেক সমস্যা দেখা দিয়েছে। পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। প্রত্যেকদিন প্রায় দেড়শ কোটি লিটার পানি উত্তোলনের ফলে প্রতি বছর তিন মিটার করে পানি নিচে নেমে যাচ্ছে। আগে ৪০০/৫০০ ফুট নিচেই পানি পাওয়া যেত এখন ১০০০/১২০০ ফুট নিচ থেকে পানি উঠাতে হয়। বিশেষজ্ঞদের ধারনা পানির স্তর এভাবে দিনদিন নিচে নেমে গেলে ঢাকার জন্য কঠিন বিপদ আসাটা অস্বাভাবিক নয়। এমি নতেই ভুমিকম্পের ঝুকিতে ঢাকার অবস্থান প্রথম দিকে।

ভূগর্ভস্থ পানি ঊত্তোলনে বর্তমানে ঢাকা ও নারায়নগঞ্জে ওয়াসার সাড়ে পাঁচশটি গভীর নলক’প রয়েছে। কোথাও পানির সমস্যা দেখাদিলেই স্থাপন করা হয় নতুন নতুন নলক’প। অনেক সময় আগের নলকূপ কাজ করলেও তার পাশে নতুন করে বসান হয় নলক’প। এখন এ নলক’প দিয়েও পানি উঠছেনা॥ কারন পানির স্তর এতোটাই নিচে নেমে গেছে যে নলকুপগুলো আর কুলাতে পারছেনা। অন্যদিকে বিদ্যুতের সমস্য। বিদ্যুতের বিকল্প হিসেবে জেনারেটর থাকলেও বিদ্যুত দিয়ে যে পরিমান পানি উত্তোলন সম্ভব জেনারেটর দিয়ে সে পরিমান পানি উত্তোলন করা যায়না। বর্তমানে মোবাইল ও স্থায়ী মোট ২৯৪ টি জেনারেটর রয়েছে। এরবাইরে আরো একশটি পাম্পে বিদ্যুতের দ্বৈত সংযোগ দৈয়া হযেছে। এরপরও উত্তোলন বাড়ানো সম্ভব হচ্ছেনা। দীর্ঘ সময় বিদ্যুত না থাকলে র্দীর্ঘ সময় জেনারেটর চালানো সম্ভব হয়না। আবার তেল সংকটের কারনেও অনেক সময় উত্তোলন ব›ধ থাকে। এসব মিলে বর্তমানে পানি উত্তোলনের পরিমান দিন দিন কমছে। অন্যদিকে গরমের মৌসুম হওয়ায় চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। চাহিদা ও যোগানের বিপরীত অবস্থায় গ্রাহকের দুর্ভোগ চরম্ ে।

ঢাকা ওয়াসার দৃষ্টি এখন আকাশে। বৃষ্টির জন্য আকাশপানে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কোন বিকল্প তাদের হাতে নেই। বৃষ্টি হলে পানি সংকট কিছূটা হলেও কাটবে। এতে একদিকে নদীর দূষন কমবে অন্যদিকে জনজীবনে স্বস্তি আসবে। আর যা হোক অন্তত গনবিস্ফোরন ঘটবেনা।
রাজধানিবাসি যাদের ওয়াসার বিকল্প পানি কেনার সামর্থ্য নৈই, ওয়াসার দুর্গন্ধ আর ঘোলা পানিই তাদের নিয়তি। তাদের কথা না হয় বাদই দিলাম,এর বাইরের যে মধ্যবর্তী শ্রেনী রয়েছ্ ে॥ যাদের টাকা দিয়ে পানি কেনার সামর্থ্য আছে। এশ্রেনী ওয়াসার পানি না খেয়ে বাইরে থেকে কিনে বিশুদ্ধ পানি খাচ্ছে। তারা কী টাকা দিয়ে আসলেই বিশূদ্ধ পানি পাচ্ছে? ঠিক এ প্রশ্নটির সাথেই রাষ্ট্রের কথাটি চলে আসে।

রাষ্ট্রের প্রশ্নে যাওয়ার আগে, এ মধ্যবর্তী শ্রেনী যে পানি খেয়ে বাঁচে সে পানির কথায় আসাযাক। এরা ওয়াসার বাইরে দোকানের বোতলজাত মিনারেল ওয়াটার
আর জারের বিশুদ্ধ পানি খান। এসব বোতলজাত আর জারের পানি কতটা নিরাপদ। এগুলো মিনারেল বা বিশুদ্ধ বলে বিক্রি করলেও এসব পানি নিয়ে অনেকদিন ধরেই গনমাধ্যমগুলো সংবাদ দিচ্ছে, এগুলো মিনারেল বা বিশুদ্ধতো নয়ই বরং এ পানির গুনাগুন! ওয়াসার পানি থেকে কোন অংশে কম নয়। মান নিয়ন্ত্রন কারি সংস্থা বিএসটিআই অনুমোদিত পানির কারখানার সংখ্যা ৩২৫ টি হলেও বাস্তবে এ কারখানার সংখ্যা পাঁচশতাধিক। ইতিমধ্যেই রাজধানিতে অনেকগুলো ভূয়া প্রতিষ্ঠান শনাক্ত করা হয়েছে।
এর আগে রাষ্ট্রের প্রশ্নটি এসেছিলো। রাষ্ট্রের সাথে আমাদে নাগরিকের সম্পর্ক অধিকারের। রাষ্ট্রযন্ত্রটরি দায়ত্বইি হলো নাগরকিকে তার অধকিার র্পূনরূপে প্রদান করা। রাষ্ট্র যদি তার এ অধকিার পালনে র্ব্যথ হয়, রাষ্ট্ররে উপর হতে নাগরকিরে আস্থা চলে যায়। র্অথা রাষ্ট্র তার মূল দায়ত্বি পালনে র্ব্যথ।রাষ্ট্র যখ ন নজিে তার দায়ত্বি পালনে র্ব্যথ তখন সে কাজটি অন্যরে দ্বারা সম্পাদতি হয়। রাষ্ট্র যখন তার মূল দায়ত্বিে র্ব্যথ এবার তার দায়ত্বি হলো রগেুলটে করা। যে রাষ্ট্ররে কাজটি করছে সে ঠকিভাবে পালন করছে কীনা তা দখো। পানরি বষিয়ে যদি বল,ি রাষ্ট্ররে দায়ত্বি ছলিো রাজধানি বাসরি পানরির্পূন নরিাপত্তাদয়ো। সটো রাষ্ট্র ওয়াসার মাধ্যমে পালন করছ।ে ওয়াসা যদি সবাইকে চাহদিা মাফকি নরিাপদ পানি দতিে পারতো অন্তত পানি প্রশ্নে রাষ্ট্র সফল হতো। এখানে ওয়াসা র্ব্যথ,রাষ্ট্র র্ব্যথ। এবার মধ্যক শ্রনেীর দৃষ্টি মনিারলে আর জাররে পানরি দকি।ে রাষ্ট্র যদি এ তার রগেুলটেরি পাওয়াররে মাধ্যমে মনিারলে বা জাররে টাকায় কনো পানরি নশ্চিয়তা বধিান করতে না পারে এখানে রাষ্ট্র পুরো র্ব্যথ। আজ আমাদরে ক্ষত্রেে সটোই হয়ছে।ে



নতৈকিতার বচিারে আমাদরে রাষ্ট্র র্ব্যথই বট।ে তবে বাস্তবতা বলে কথা। রাজধানরি পানরি সংকটরে ক্ষত্রেে যে সমস্যাগুলোর কথা বলা হয়ছেে সগেুলো থকেে উত্তরনই এখন রাষ্ট্ররে প্রধান কাজ হওয়া উচতি।আমাদরে এখন স্বল্পময়োদি এবং র্দীঘময়োদি দু ধরনরে পরকিল্পনা নয়িে এগুতে হব।ে পানি চুরি এবং অপচয় রোধ হবে প্রথম দায়ত্বি।সরকার পানি সমস্যার জন্য সনোবাহনিীকে মাঠে নামানোর কথা বলছে।ে এ সনোবাহনিীর প্রয়োজন আসলে কনে, পানি ব্যবস্থাপনার জন্য নাকি গনবস্ফিোরন রোধলে জন্য?
ব্যস্থাপনাতো ওয়াসা একটু সচতেন হলইে সম্ভব। ওয়াসা ইতমিধ্যে সংকট নরিসনে যে পদক্ষপেরে কথা বলছেে সগেুলো নহোয়তে মন্দ নয়। তাৎক্ষনকিভাবে সে পদক্ষপেই বাস্তবায়ন করা হোক।র্দীঘ ময়োদি পরকিল্পনায় গভীর নলকূপরে মাধ্যমে পানি উত্তোলন বন্ধ করা জরুর।ি ওয়াসাকে ভূর্গভস্থ পানতিে ভরসা না করে ভূউপরভিাগরে পানকিে ভরসা বাড়াতে হব।ে এক্ষত্রেে পানি সরবরাহ ও অবকাঠামোকে বকিন্দ্রেীকরন করে মিরপুর , উত্তরা মডলে টাউন এবং মো:পুর এ আলাদা পানি শোধানাগার করা যতেে পার।ে
এলাকাভত্তিকি এ পানি শোধানাগার করা গলেে সমাধান দ্রুত সম্ভব। এজন্য রাজধানরি বুড়গিগ্ঙ্গা ও শীতলক্ষ্যার দূষতি পানরি বাইরে পদ্মা ও মঘেনা নদী থকেে পানি আনতে হব।েসরকাররে সে দকিে দৃষ্টি আছে বলে জানা গছে,ে এ দু নদীর দুটি প্রকল্পরে ব্যাপারে দাতা সংস্থার সাথে আলোচনা চলছ।ে ২০১১ সাল নাগাদ সায়দোবাদরে দ্বতিীয় প্রকল্পটি শুরু হবে বলে কাজ শুরু হয়ছে।ে
ঢাকার চারপাশরে বুড়গিঙ্গা, তুরাগ, শীকলক্ষ্যা, বালি এসব নদীগুলোকে দূষনরে হাত থকেে বাঁচালইে আমাদরে পানরি সংকট দূর হয়ে যায়। বাস্তবতা হলো এসব নদীর পানি এতটাই দূষতি যে শোধনরে অযোগ্য। র্বতমানে এসব পানি খয়েে ঢাকার নম্মিবৃত্তরে মানুষগুলোর ভড়ি আইসডিডিআিরবি ত।ে
পানরি এ সমস্যা শুধু রাজধানীতইে নয়। গোটা দশেতো বটইে,গোটা বশিাবব্যাপী এ সমস্যা। বশ্বিরে তনি ভাগরে দুইভাগ মানুষ মাত্র সুপয়ে পানি পায়। বশিষেজ্ঞদরে ধারনা ২০২৫ সাল নাগাদ বশ্বিরে তনিভাগরে একভাগ মানুষ সুপয়ে পানি পাব,েদুই ভাগই বনচতিো হবে সুপয়ে পানি হত।

আজকরে বশ্বিে একজন কনেয়িান দনিে ৩ গ্যালন পানি খরচ কর,ে যুক্তরাজ্যরে একজন খরচ করে ৩০ গ্যালন আর একজন আমরেকিান দনিে পানি খরচ করে ১৫০ গ্যালন মাত্র!। তবে আমরেকিার জন্যও সুখরে সংবাদ নইে, কারন অচরিইে সখোনে ৩৫ ভাগ মানুষ পানরি সংকটে ভুগব।ে
বশিষেজ্ঞদরে ধারনা প্রথম ও দ্বতিীয় বশ্বিযুদ্ধরে পর তৃতীয় বশ্বিযুদ্ধটি হবে পানি নয়ি।ে সে যুদ্ধে আমাদরে অবস্থান কী হব,ে যখোনে জনগনরে বস্ফিোরন ঘটতে যাচ্ছে আর আমাদরে রাষ্ট্র তার জন্য মোতায়নে করছে সনোবাহনিী।

নারী শিক্ষা, উন্নয়ন ও বাস্তবতা (ৈদিনক েডসিটিন ১০-০৩-২০১০)





নারী শিক্ষা, উন্নয়ন ও বাস্তবতা

মাহফুজুর রহমান মানিক
৮ মার্চই যদি নারী দিবস হয় বাকী দিনগুলো কী? অর্থাৎ অনেকে বলেন বছরের একটি দিন মাত্র নারীর আর বাকী দিনগুলো কী পুরুষের? তাহলে একদিন নারী দিবস নির্ধারন করে প্রকারান্তরে নারীদের কী খাটো করা হলো। একদিকে চিন্তা করলে এ যুক্তি অমূলক নয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো অবহেলিত নারীর ঘুরে দাঁড়ানোর সুচনাটা এ দিন ছিলো বলেই, দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে নারী দিবসের অবতারনা। মূলত প্রত্যেকটি দিনই যেমনভাবে পুরুষের তেমনি নারীরও।নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে সবসময়ই প্রতিবন্ধকতা থাকে। দেশের প্রায় ৭৫ ভাগ মানুষ গ্রামে বাস করেন। গ্রামের অধিকাংশ মানুষই মনে করেন তাদের মেয়েদের এসএসসির পর পড়ানো মানে বেহুদা খরচ। অনেকেতো তারও আগে মেয়েদের পড়াশোনা বাদ দিয়ে দেন। তাদের ভাবনা বউ, সংসার আর সন্তান উৎপাদনই মেয়েদের প্রধান কাজ। এর জন্য পড়াশোনার প্রয়োজন নেই। ফলে গড়ে ১৫ বছরেই মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়। বউ হয়ে আবার পড়াশোনার সুযোগ কোথায়। ফলে দেশের একটা বড় অংশের মেয়েরা একটা পর্যায়ের পর নিশ্চিতভাবে পড়াশোনা থেকে ঝরে পড়ছে।শহরে বাকী যে ২৫ ভাগ মানুষ বাস করেন এর ১০ ভাগই বলা যায় অত্যন্ত মানবেতর জীবন যাপন করেন। যারা তাদের মেয়ে সন্তান কেনো পুত্র সন্তানদেরই পড়াশোনা করাতে পারেন না। বাকী থাকলো ১৫ ভাগ, যারা মনমানসিকতা, অর্থসম্পদে উচ্চমানের, এদের সন্তানরা ছেলে হোক মেয়ে হোক উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে। অবশ্য গ্রামেও অনেক আধুনিক চিন্তার অধিকারী মানুষ আছেন, সমস্যা হলো অর্থনৈতিক। মেয়েদের পড়াশোনার জন্য একদিকে পর্যাপ্ত প্রতিষ্ঠান নেই আবার দূরে বা শহরে পড়াশোনা করানোর মতো অনেকের সামর্থও নেই।ধর্মীয় গোড়ামীর কারণেও অনেকে মেয়েদের প্রতিষ্ঠানে পাঠাতে চান না। কবি নজরুল পঞ্চাশ বছর আগে এ বিষয়টি বলে গেলেও বাস্তবতা এখনও বলবৎ আছে। তার কবিতার লাইন-‘বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে/আমরা তখনো বসে বিকি তালাকের ফতোয়া খুঁজছি/কোরানও ফিকাহ চষে’। নারী শিক্ষার প্রতিবন্ধকতা যেমন মানসিকতা, অর্থনৈতিক সমস্যা কিংবা গোঁড়ামি একই সাথে নিরাপত্তাও বটে। যেমন আজকের পিংকীরা আত্মহত্যার পথ বেঁচে নিচ্ছে মুরাদ নামক নরাধমদের কারণে কিংবা ক্যাম্পাসে ছাত্রের হাতে লাঞ্ছিত হচ্ছে ছাত্রী। নিরাপত্তাজনিত কারণে অনেক অভিভাবক তার মেয়েকে প্রতিষ্ঠানে পাঠাতে ভয় পান।এতসব প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও এ পর্যায়ে দাড়িয়ে আমরা বলতে পারবো আমাদের নারীরা এখন আর শিক্ষায় তেমন পিছিয়ে নেই। বেগম রোকেয়ার কাছে যখন শিক্ষা অফিসার গ্রাজুয়েট নারীর তালিকা পেয়েছে, তার সময়ে তিনি ক’জন পেয়েছেন, তার কথা-‘কিন্তু আমি বঙ্গের মাত্র একটি গ্রাজুয়েট এবং আগা মইদুল সাহেবের কন্যাত্রয় ব্যতীত আর কাহারো নাম দিতে পারিনাই। আর এখন শুধু গ্রাজুয়েটই নয় বিসিএস এর ২৮ টি ক্যাডারে পাঁচ হাজারের ও বেশি নারী কাজ করেন। আর গ্রাজুয়েশন করে অন্যান্য চাকরিতে তো নারীরা আছেনই।আমাদের জাতীয় শিক্ষায় পুরুষের তুলনায় নারীর অনুপাতও একেবারে কম নয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০০৫ এর তথ্য মতে, (তার আগে একটু বলে রাখি, অত্যন্ত দু:খের বিষয় এখন ২০১০ সাল আর পাঁচ বছর আগের পরিসংখ্যান এখানে দিতে হচ্ছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা এর অধীনে যে ব্যানবেইজ আছে এরা কী প্রতি দু’বছর অন্তর অন্তর জাতিকে নতুন পরিসংখ্যান দেখাতে পারে না?) প্রাথমিক স্তরে মোট শিক্ষার্থী ১ কোটি ৬২ লাখ ২৫ হাজার ৬৫৮ জন এর মধ্যে ছাত্রী ৮১ লাখ ৩৪ হাজার ৪৩৭ জন। এখানে ছাত্রী অর্ধেকের চেয়ে একটু বেশি। মাধ্যমিকের চিত্র আরেকটু ভালো, মোট শিক্ষার্থী ৭৩ লাখ ৯৮ হাজার ৫৫২ জন, ছাত্রী ৩৮ লাখ ৬৮ হাজার ১৪ জন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের এ দু’টি পরিসংখ্যান থেকে আরেকটু দেখার বিষয় হলো প্রাথমিকে মোট শিক্ষার্থী ১ কোটি ৬২ লাখ হলেও মাধ্যমিকে এ সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র প্রায় ৭৪ লাখ অর্থাৎ অর্ধেকের বেশি ছেলে এবং মেয়ে প্রাথমিক শিক্ষা হতে ঝরে গেছে। বিষয়টা উদ্বেগেরই বটে।কলেজ লেভেলে এসে (এইচএসসি ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি, স্নাতক, স্নাতকোত্তরসহ) ছাত্রী সংখ্যা কিছুটা কমলেও হতাশ হওয়ার মতো চিত্র নয়, মোট শিক্ষার্থী ১৩ লাখ ৬৭ হাজার ২৪৬ জন, ছাত্রী ৫ লাখ ৬৯ হাজার ৩৩৭ জন। বিশ্ববিদ্যালয়ে (পাবলিক ও প্রাইভেট) এসে অবশ্য আনুপাতিক হারে ছাত্রী বেশ কমে গেছে, মোট শিক্ষার্থী ২লাখ ৭ হাজার ৫৭৭ জন, ছাত্রী ৪৯ হাজার ৮৬৭ জন। আমাদের নারী শিক্ষার তুলনামূলক চিত্র খুব বেশি খারাপ নয়। ২০০১ এর শেষ ও চতুর্থ আদমশুমারী অনুযায়ী পুরুষ এবং নারীর অনুপাত যথাক্রমে ১০৩.৮:১০০। আবার নারী শিক্ষার এ চিত্র আরো পাঁচ বছর আগের সে হিসেবে বর্তমানে এ সংখ্যা বাড়বে নিঃসন্দেহে।আজকে বিশ্বব্যাপী নারীর জাগরন হয়েছে। বাংলাদেশেও তার ছোঁয়া লেগেছে। নারীরা উচ্চশিক্ষিত হয়ে সকল সেক্টরে ভূমিকা রাখছে। তবে অনেক সময় আমরা নিজেরাই সেটা মেনে নেইনা। এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা বলা যেতে পারে। বাংলাদেশি এক শ্রমিক বিদেশে কাজ করতে যাবে। সকল কিছু সেরে বিমান বন্দরে এসেছে। বিমান চড়েই তার যায়যায় অবস্থা। সুস্থ মানুষ হঠাৎ বিমান চড়ে অসুস্থ। সবাই তাকে ধরাধরি করে শুশ্রƒষা করছে। শ্রমিকের ভাবটা এমন যেনো সে ভয় পেয়েছে। তাকে জিজ্ঞেস করা হলো কী সমস্যা, কোন সমস্যা নয়। অবশেষে জানা গেলো বিমান চালক (পাইলট) কে দেখে তার এ অবস্থা। কারণ চালক ছিলো একজন মহিলা। লোকটা ভেবেছে একজন মহিলা কিভাবে বিমান চালাবে, সে তো নির্ঘাৎ অ্যাক্সিডেন্ট করবে। তার ভাবনা বিমান শুধু পুরুষরাই চালাতে পারে, নারীরা নয়।নারী শিক্ষা দিয়ে শুরু করছিলাম। আজকে নারী জাতি যত শিক্ষিত হবে আমাদের উন্নয়নের পথ ততই শানিত হবে। শিক্ষা আর উন্নয়ন দু’টি একটি অপরটির পরিপূরক। নারীরা শিক্ষিত হয়ে কোন চাকরি না করলেও তারা উন্নয়নে অনেক ভূমিকা পালন করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে নেপোলিয়ানের কথাটি না বললেই নয়। তিনি বলেছেন- তুমি আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাকে শিক্ষিত জাতি উপহার দেবো। শিক্ষিত জাতি মানেই উন্নত জাতি। বেগম রোকেয়া যেমন নারীদের সমাজের অর্ধাঙ্গী কল্পনা করেছেন, তেমনি প্রত্যেক পুরুষকে তার স্ত্রীকে অর্ধাঙ্গী হিসেবে দেখা উচিত। তাদের মেয়ে সন্তানদের মনে করা উচিত আগামী দিনের যোগ্য নাগরিক। আমাদের রাষ্ট্র যদি রাষ্ট্রীয় উন্নতি চায়, সকলের অধিকার নিশ্চিত করতে চায় অবশ্যই নারীদের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। নারীর শিক্ষার সুবিধা আরো বাড়াতে হবে। চীনাদের যে প্রবাদ, ‘যদি একশ বছরের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করো তবে মানুষকে শিক্ষিত করে তোল। এখানে নারী শিক্ষা ও গুরুত্বপূর্ন। এক্ষেত্রে শুধু রাষ্ট্রকেই নয় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিও ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। এরপর নারী পুরুষ সকলের প্রচেষ্টায় আমরা দেশকে উন্নতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবো।

গরিব, আগুনে বড়লোক ! (ৈদিনক েডসিটিন ০৩-০৩-২০১০)





মাহফুজুর রহমান মানিক
গরিব, আগুনে বড়লোক!

আমাদের জাতীয় জীবনে ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ একটা শোকের দিন। গত বছরের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারির বিডিআর বিদ্রোহে ৫৭ জন প্রশিক্ষিত সেনা নায়কদের আমরা হারিয়েছি। ২০১০-এ এসে ২৫ ফেব্রুয়ারি যখন নিহত সেনা কর্মকর্তাদের স্মরণ করে চোখের পানি ফেলছি, তখনি আরেক দুঃসংবাদ এসে উপস্থিত। ২১ জন মূল্যবান শ্রমিকের লাশ। গাজীপুরের গরিব এন্ড গরিব সোয়েটার কারখানায় আগুন। আগুনের ভয়াবহতা খুব বেশি না হলেও একসাথে এতো শ্রমিকের মৃত্যু আমাদের ব্যথাতুর হৃদয়কে আরো ব্যথিত করে। আগুনে একজন শ্রমিকেরও হতাহত হওয়ার কথা নয় সেখানে একুশটি নিরীহ প্রাণ ঝরে গেল। কতটা নির্মম ঘটনা। আমরা যদি একুশ শতকের আগুনে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে, এমন একটি ঘটনার কথা বলি তাও প্রবোধ পাই না, ২০০৪-এ প্যারাগুয়ের আসুনসিয়নে একটি সুপার মার্কেটে আগুন লেগে ৩শ ৭০ জন নিহত হয়, সে ঘটনায় আগুনের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন তারা, কিন্তু আমাদের এ শ্রমিকরা আগুনের প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎ না পেয়েও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। সচেতনতা, বুদ্ধি কতটা গুরুত্বপূর্ণ এ ঘটনা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে। প্রায় প্রত্যেকটি সংবাদপত্রই বিষয়টাকে প্রধান শিরোনাম করেছে। কেউ লিখেছে ‘কাল হলো নিরাপত্তার তালা’, কারো শিরোনাম ‘বন্ধ দরজা আর বিষাক্ত ধোঁয়ায় মারা গেলো তারা’। এসব ঘটনা আমাদের যতই সাবধান করে আমরা ততই বোকা হচ্ছি মনে হয়। কারণ এর কিছুদিন আগেও ঠিক এ রকম ঘটনায় জাপান গার্ডেন সিটিতে একই পরিবারের সাতজন মারা যায়।
আগুনের কারণে মৃত্যুর মিছিলের দৈর্ঘ্য এভাবে কত বড় হবে। এবার যেখানে গার্মেন্টস এ আগুন। গার্মেন্টস শিল্প বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান শিল্প বটে, এ শিল্প থেকে আমাদের মোটা অংকের রফতানী আয় অর্জিত হয় বটে, এতে এ শিল্পের মালিকরা অনেকে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হন বটে, কিন্তু যাদের শ্রমের বিনিময়ে বর্তমানে এ শিল্প জয়জয়কার সে শ্রমিকরা বরাবরের মতোই নিগৃহীত। অজ পাড়াগায়ের নিঃস্ব মানুষগুলো একটু বাঁচার তাগিদে এখানে কাজ করে। সারাদিন কলুর বলদের মতো খেটেও ৩/৪ হাজার টাকা আয় করাও তাদের অসম্ভব হয়ে পড়ে। তারপরও মালিকরা ঠিকমতো টাকা পরিশোধ করে না। প্রায়ই আন্দোলন করে শ্রমিকদের টাকা আদায় করতে হয়। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো এখানে আমাদের অনেক নারী শ্রমিক কাজ করেন। আমাদের এসব মা আর বোনরা পারিবারিক কাজের পাশাপাশি অর্থনৈতিক কাজেও পরিবারকে সাপোর্ট দিতে কাজ করেন। এসব কর্মরত মা বোনদের নির্যাতনের খবর প্রায়শই শোনা যায়। তবুও পেটের জ্বালায় কাজ করে যান।
গরিব এন্ড গরিব সোয়েটার কারখানায় আগুনের ঘটনায় যারা মারা গেছেন তাদের অধিকাংশই নারী। ২১ জনের মধ্যে ১৫ জন নারী বাকি ৬ জন পুরুষ। নিঃস্ব এসব নারী কতোটা খাটুনি খেটে পরিবারকে অর্থনৈতিক সাপোর্ট দিতেন ভাবা যায়? যখন তার সন্তান মায়ের লাশ নিতে এসে বলে, ‘গরিবে কাজ করতে এসে মা এখন বড়লোক।’ মানবতার প্রতি কতোটা কটাক্ষ। ছেলে মায়ের লাশের কফিনের জন্য ১৫ হাজার টাকা পেয়ে, আর পরিবারের জন্য ২ লাখ টাকা ঘোষণায় এ মন্তব্য করে।
গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী শ্রমিকদের ঘামে পণ্য তৈরি করে বাজারে বিক্রি করে, বিদেশে রফতানি করে টাকা পায়। শ্রমিকদের ভাগ দিতে গেলেই, তাদের অধিকার দিতে গেলেই সব শেষ, নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়। শ্রমিকদের নিরাপত্তা তো অনেক দূরে। আগুন লাগা এ গার্মেন্টসে কথাই ধরা যাক, আট মাসে তিনবার আগুন। গত বছরের আগস্ট মাসে এ কারখানায় অগ্নিকান্ডের ঘটনায় একজন দমকল কর্মীর নির্মম মৃত্যু হয়। এরপরও টনক নড়েনি মালিকের। কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি, উল্টো ছয় তালার বিল্ডিংকে অবৈধভাবে বানিয়েছে সাত তলা।
শুধু এ গার্মেন্টসই নয় অন্যান্যরাও যে সচেতন তা কিন্তু নয় বা আগুনের ঘটনা যে শুধু এ গার্মেন্টসে হয়েছে তাও নয়। একটি সংবাদপত্রের প্রতিবেদন আনুসারে পোশাক কারখানায় আগুনে বছরে প্রাণহানি ঘটে ৪১ শ্রমিকের। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০০ সাল থেকে এ পর্যন্ত আগুনে পুড়ে কমপক্ষে ৪১৪ জন শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গার্মেন্টসে আগুনের বড় ঘটনা ঘটে ২০০৬ সালে। সে বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের কেটিএস কম্পোজিট টেক্সটাইল মিলে আগুন ধরলে ৯১ জন শ্রমিক পুড়ে মারা যান। এর আগের বড় ঘটনা ২০০০ সালের ২৫ নভেম্বর নরসিংদীর চৌধুরী নিটওয়্যার এন্ড গার্মেন্টস লিমিটেড এ আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যান ৫৩ জন শ্রমিক।
পোশাক শিল্পে আগুনেই শ্রমিক হতাহত হয়নি বরং প্রতিনিয়ত সংঘর্ষ, ফ্যাক্টরি ধস, শ্রমিক অসন্তোষ এবং নিরাপত্তার অভাবে অনেক শ্রমিক মারা যায়। পোশাক শিল্পের ইতিহাসে আমাদের দেশে ১৯ বছর আগে প্রথম অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। সে ঘটনার ধারাবাহিকতায় ১৫০ বারের অধিক এ শিল্প-কারখানায় আগুন লাগে। আগুনের সাথে শ্রমিকদের মৃত্যুর সংখ্যা তো বাড়ছেই।
আমাদের এ আগুনের বিষয়টি যে শুধু গার্মেন্টস এর সাথে জড়িত তা নয়। গার্মেন্টস ছাড়াও প্রতিনিয়তই বিভিন্ন স্থানে দেখছি আগুন। ২৫ ফেব্রুয়ারির পোশাক শিল্পের এত বড় আগুনের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ২৮ তারিখ মিরপুর তালতলার বস্তিতে আগুন, এখানে কেউ হতাহত না হলেও অনেক ঘর পুড়ে গেছে। ক্ষতির পরিমাণও কয়েক লাখ টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এভাবে আগুনে পুড়ে প্রতিবছর আড়াইশ কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয় বলে সম্প্রতি একটি সাপ্তাহিকের প্রতিবেদনে জানা যায়। অগ্নিকান্ডের (নির্বাপণ) সাথে জড়িত সরকারি প্রতিষ্ঠান ফায়ার সার্ভিস-এর তথ্যমতে, ২০০৮ সালে ৯ হাজার ৩শ দশটি অগ্নিকান্ডে ফায়ার সার্ভিসের ৪ জনসহ প্রাণ হারিয়েছে ১শ ৬ জন, ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২শ ৩১ কোটি টাকা। গত বছরের এনসিটিবি, বসুন্ধরা এর আগে বিএসইসি ভবনের আগুনের ঘটনা ছিলো অন্যতম আলোচিত ইস্যু।
বিশ্বব্যাপিও আগুনের ঘটনা কম নয়। গত বছরে থাইল্যন্ডের রাজধানী ব্যাংককের সানটিকা ক্লাবে আগুনে পুড়ে মারা যায় ৫৬ জন। ২০০৭ এ রাশিয়ায় একটি নার্সিং হোমে আগুনে মারা যায় ৬৩ জন। এভাবে হংকং, কানাডা, ইরান, মস্কোসহ বিভিন্ন দেশে অনেক অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। তবে আমাদের দেশের মতো এত রেকর্ড পরিমাণে অগ্নিকান্ড কোথাও সেভাবে ঘটেনি। আমাদের দেশে অগ্নিকান্ড ঘটলেও ভবিষ্যতের জন্য সাবধান হই না। সাবধানতার কথা বললে অনেক বিষয়ই আসবে, একটা হলো ব্যক্তিগত সাবধানতা অন্যটা, সরকারের বা প্রশাসনের সাবধানতা। প্রত্যেকটি স্থাপনা বা বিল্ডিং তৈরির সময় স্বাভাবিকভাবেই ভবনটির নিরাপত্তার যাবতীয় বিষয় দেখারই কথা, এ ক্ষেত্রে আগুনের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। বাস্তবতা হলো রাজধানীর অধিকাংশ বহুতল ভবনই এদিক থেকে অরক্ষিত। অনেক ভবনে হয়তো ব্যবস্থা থাকলেও সেখানে নেই প্রশিক্ষিত জনবল। গত বছরের বসুন্ধরা সিটিতে আগুনের সময় বিষয়টি দেখা যায়। পাশাপাশি প্রশাসনিকভাবেও আমাদের অনেক দুর্বলতা রয়ে গেছে। বিএসইসি ভবনে আগুন লাগার পর বিষয়টি চোখে পড়ে। ফায়ার সার্ভিসে বহুতল ভবনে অগ্নিনির্বাপনের উঁচু মই নেই। ২০৭টি ফায়ার স্টেশনের জন্য ২০৭টি অ্যাম্বুলেন্সের প্রয়োজন হলেও আছে মাত্র ৬৩টি। সেভাবে দক্ষ জনবলও নেই। অনেক সময় দেখা যায় প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাবে দ্রুত আগুন নেভানো সম্ভব হয় না।
গার্মেন্টস শ্রমিকদের কারখানায় আগুনের বিষয়টি এ ২১ জন শ্রমিক হতাহত হওয়ার পরও যে খুব একটা আলোচনায় এসেছে তা বলা যায় না। সংবাদপত্রগুলো শিরোনাম, সম্পাদকীয় করেছে ঠিকই তবে বাস্তব উদ্যোগ চোখে পড়ার মতো নয়। এ ঘটনায় মালিক গা ঢাকা দিয়েছেন, দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদের প্রতিবেদন কবে প্রকাশ হবে, প্রকাশ হলেও বাস্তব কার্যকারিতা বা দোষীদের শাস্তি দেয়া হবে কিনা তার নিশ্চয়তা নেই। সবচেয়ে বড় কথা হলো যে কারণে অগ্নিকান্ডের ঘটনা অর্থাৎ বৈদ্যুতিক ব্যবস্থার উন্নতি, শ্রমিকদের পরবর্তী নিরাপত্তার ব্যবস্থা আদৌ নেয়া হবে কিনা তার নিশ্চয়তা নেই। কারণ এর আগেও এমন অনেক দুর্ঘটনা ঘটেছে, হতাহত হয়েছে, তদন্ত কমিটিও গঠন হয়েছে। এরপর অনেক সময় তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হয় না, হলেও সে সুপারিশ বাস্তবায়ন হয় না।
আমেরিকাসহ আনেক উন্নত বিশ্ব আমাদের কাছ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি করে। এসব দেশ কখনোই চায় না এভাবে আমাদের শ্রমিকরা মারা যাক। এখানে গার্মেন্টস এ কমপলায়েন্টস সুবিধা, শ্রমিকদের বেতন-ভাতাদির ব্যাপারে সচেতন। গত মাসে আমেরিকার বাজারে রফতানি হওয়া আমাদের পোশাকের ৩০ শতাংশ যে কোম্পানি নেয়, সে ওয়ালমার্টের প্রধান নির্বাহী আমাদের দেশে আসেন। ডগলাস ম্যাকমিলান নামে সে ভদ্রলোককে আমাদের শিল্প মালিকরা বলেন, শিল্প কারখানায় প্রয়োজনীয় সকল সরঞ্জাম রয়েছে, এমনকি গত ২০০৬ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে শ্রমিকদের বেতন। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য এর ক’দিন পরই এ ঘটনা। এ ঘটনার ম্যাকমিলান কিভাবে নেবে। সে যাই হোক, আমাদের মনে রাখা উচিত পোশাক রফতানি শুধু আমরাই করছি না আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বীও আছে। ভারত, শ্রীলংকা, ভিয়েতনামের মতো বড় পোশাক শিল্প উৎপাদন ও রফতানিকারক দেশ বাংলাদেশকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে। এমনকি চীনও এ বিষয়টি নিয়ে অন্তত আমাদের সাথে হিংসা করে।
গরিব এন্ড গরিব সোয়েটার কারখানায় কাজ করতে এসে ২১জন শ্রমিকের লাশ হওয়া আমরা দেখলাম। শ্রমিকদের লাশের এ সারি কখনো কী আমাদের হৃদয়কে একটু নাড়া দিয়েছে? গরিব এ শ্রমিকরা কাজ করতে এসেছে গরিব কারখানায়। তাদের এ গরিবি অবস্থার উন্নয়ন হয়নি কখনো। মাসে মাসে যা পেতো তাতে নুন আনতে পান্তা ফুরায়। এ শ্রমিকরা কখনো একসাথে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখেনি। যে সুফিয়া খাতুন (৪৫) তার ক্যান্সার আক্রান্ত স্বামীকে বাঁচানোর জন্য চাকরি নিয়েছে গার্মেন্টস এ, তার কাছে লাখ টাকার স্বপ্ন থাকাই স্বাভাবিক। সে সুফিয়া লাখ টাকা পাওয়ার অঙ্গিকার পেয়েছে বেঁচে নয়, নিজে লাশ হয়ে। এ শ্রমিক কত দিন কাজ করে পেতো লাখ টাকা। তাদের দারিদ্র্যের বোঝা কী ঘুচতো। বিজিএমইএ প্রত্যেক পরিবারকে দু’লাখ টাকা করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এখন তারা আর গরিব নয় লাশ হয়ে বড়লোক হয়ে গেছে। গরিব কারখানায় গরিব মানুষ কাজ করে বড়লোক! হায় সেলুকাস! এভাবে লাশ হয়ে আর কতো পরিবার বড়লোক হবে। কতো অগ্নিকান্ড ঘটবে। পত্রিকায় কতো শিরোনাম আসবে। কতো সুফিয়া স্বামীকে হাসপাতালে রেখে তাকে বাঁচানোর জন্য নিজে মরবে। কত মা তার আলমগীরের বাজারের আশায় বসে থাকবে। আলমগীর না আসলে বাজার করার টাকা আসবে কোথা থেকে? সে টাকায় ক’দিন একমাস, ছয়মাস, এক বছর, এরপর? এসব প্রশ্ন কাকে করবো? উত্তর দেয়ার মতো বুকের পাঠা কারো আছে, না এভাবে গরিব আগুনে বড়লোক হতেই থাকবে! য়

জাতীয় শিক্ষানীতি ও শিক্ষায় ভাষা মাধ্যম (ৈদিনক েডসিটিন ২৭-০২-২০১০)





মাহফুজুর রহমান মানিক
জাতীয় শিক্ষানীতি ও শিক্ষায় ভাষা মাধ্যম
ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। এ মাসের আন্দোলনকে অনেকে বলেন ভাষা আন্দোলন। শুধু ভাষা আন্দোলন বললে ভাবটা পূর্নাঙ্গ হয়না, বলা উচিত রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন। ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখকে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। এ বছরের একুশ তারিখ সবে গত হলো। অবশ্য ফেব্রুয়ারি এখনও বিদ্যমান। ফেব্রুয়ারির সংগ্রামের মাধ্যমে আমরা যে বাংলা পেয়েছি, সে সংগ্রাম আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। একুশে ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯ সাল থেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বিশ্বের সকল দেশ দিবসটি পালন না করলেও তারা জানে একুশে ফেব্রুয়ারিকে। অনেক দেশ দিবসটি পালনও করে। এ ফেব্রুয়ারি আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, চেতনা আর গর্বই নয়। আমাদের কন্ঠ, আলাদা জাতিসত্তার পরিচয়, স্বাধীন পতাকার সূতিকাগারও বটে।মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে প্রত্যেককে কথা বলতে হয়। প্রয়োজন পূরণে ব্যবহার করতে হয় ভাষা। পরস্পরের ভাব আদান প্রদানে, যোগাযোগে, চলতে-ফিরতে সর্বত্র ভাষার প্রয়োজন। ভাষা ব্যবহারের সবচেয়ে বড় যে ক্ষেত্র সেটি শিক্ষা। শিক্ষাগ্রহণ ও প্রদানে ভাষার ব্যবহার অনস্বীকার্য। শিক্ষার উপাদান হিসেবে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, প্রতিষ্ঠান, বই ইত্যাদিকে চিহ্নিত করা হয়। এর বাইরে ভাষা যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা অনেকেরই দৃষ্টি গোচর হয় না। ভাষার মাধ্যমেই একজন শিক্ষক শিক্ষা দেন। এ ভাষার বিষয়কে শিক্ষাবিজ্ঞানে বলা হয় ‘মিডিয়াম অব ইন্সট্রাকশন’। এ মিডিয়াম অব ইন্সট্রাকশন বা শিক্ষাদানের মাধ্যম হিসেবে ভাষার সার্থক ব্যবহারের মাধ্যমেই শিক্ষায় সফলতা আসে। স্বাভাবিকভাবেই এ ভাষা মাধ্যম শিক্ষায় ব্যাপক ভূমিকা রাখতে সক্ষম।আমাদের দেশে এ ভাষা মাধ্যম নিয়ে খুব কমই মাতামাতি হয়। ব্যতিক্রমটা ফেব্রুয়ারি। অর্থাৎ এ ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে ভাষা মাধ্যম নিয়ে কিছু আলোচনা শোনা যায়।পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেক দেশেই নিজস্ব ভাষায় শিক্ষা দেয়া হয়। আমাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। সংগ্রাম করে আমরা বাংলা পেয়েছি। স্বাভাবিকভাবেই বাংলাই আমাদের শিক্ষার মাধ্যম হওয়া উচিত। এ শিক্ষার মাধ্যম নিয়ে এবারের শিক্ষানীতির নির্দেশনা কী? এর বাস্তবতাইবা কতটুকু ইত্যাদি নিয়ে আলোচনার প্রয়াস চালাচ্ছি। (যদিও শিক্ষানীতি এখনও খসড়াই রয়ে গেছে। চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়া চলছে।)শিক্ষানীতিতে ভাষা মাধ্যম বা মিডিয়াম অব ইন্সট্রাকশনের দৃষ্টিভঙ্গি শিক্ষাস্তর অনুযায়ী দেখা যাক। শিক্ষাস্তর তিনটি হলো প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষা। অবশ্য প্রাথমিকের আগে প্রাক-প্রাথমিককে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রাথমিক স্তরের আগে বলে প্রাক-প্রাথমিকের আলোচনা প্রথমেই এসেছে। এ স্তরে ভাষার কথা স্পষ্ট না থাকলেও শিক্ষাদান পদ্ধতি এসেছে। শিক্ষানীতির দ্বিতীয় অধ্যায়ে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার কৌশল শিরোনামে বলা হয়েছে, ‘অন্যান্য গ্রহণযোগ্য উপায়ের সঙ্গে ছবি, রং, নানা ধরনের সহজ আকর্ষণীয় শিক্ষা উপকরণ, মডেল, হাতের কাজের সাথে সাথে ছড়া, গল্প, গান ও খেলার মাধ্যমে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হবে।’আসি প্রাথমিক শিক্ষায়। প্রাথমিক শিক্ষায় ও ভাষা মাধ্যম নিয়ে স্পষ্ট কিছু নেই। প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য উদ্দেশ্যে শিক্ষাদান পদ্ধতি এবং আদিবাসিদের ভাষা নিয়ে স্পষ্ট বক্তব্য এসেছে। সংশ্লিষ্ট তিনটি লক্ষ্য উদ্দেশ্য হলো-‘মানবিক বিকাশ এবং দেশজ আবহ ও উপাদান ভিত্তিক পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক রচনা এবং অনুসরন করা।কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে এবং অভিন্ন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি সব ধরনের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ানো বাধ্যতামূলক করা হবে।প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে আদিবাসি সহ সকল ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জন্য স্ব স্ব মাতৃভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা করা হবে।এরপর প্রাথমিক স্তরে শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যবস্তু শিরোনামে কিছু নির্দেশনা দেয়া আছে, এখানে বাংলার কথা বলা না থাকলেও ইংরেজির কথা বলা হয়েছে, ‘মানসম্পন্ন ইংরেজি লিখন কথনের লক্ষ্যে যথাযথ কার্যক্রম শুরু থেকেই গ্রহণ করা হবে এবং ক্রমান্বয়ে ওপরের শ্রেণীসমূহে প্রয়োজন অনুসারে জোরদার করা হবে।’মাধ্যমিকের ব্যাপারে শিক্ষানীতির চতুর্থ অধ্যায়ে বিবৃত হয়েছে। এ স্তরের কৌশল শিরোনামে প্রথমেই এসেছে শিক্ষার মাধ্যম। বলা হয়েছে, ‘শিক্ষার মাধ্যম এই পর্যায়ে মূলত বাংলা হবে। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামর্থ অনুযায়ী নির্দিষ্ট পাঠ্যসূচি ইংরেজি মাধ্যমেও শিক্ষা দেয়া যাবে। বিদেশীদের জন্য সহজ বাংলা শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকা বাঞ্চনীয়।’মাধ্যমিকের পর উচ্চশিক্ষা। উচ্চ শিক্ষায় ভাষা নিয়ে আলোচনা এসেছে উচ্চশিক্ষার কৌশল হিসেবে। অনেকগুলো কৌশলের মধ্যে দুটি কৌশল ভাষা সংক্রান্ত। এর একটি হলো, ‘বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে সকল ডিগ্রি কোর্স পর্যায়ে ১০০ নম্বরের / ৩ ক্রেডিট ইংরেজি বিষয় সকল শিক্ষাথীর জন্য বাধ্যতামূলক হবে।’অন্যটি হলো-‘উচ্চশিক্ষার শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি হবে আধুনিক ও আন্তর্জাতিক মানের। উচ্চশিক্ষায় বাংলা সম্প্রসারিত ও সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে ইংরেজিসহ অন্যন্য ভাষায় রচিত আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের ব্যবহারযোগ্য গুরুত্বপূর্ণ রচনা বাংলা ভাষায় ভাষান্তরিত হওয়া প্রয়োজন। এই কাজকে জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ গণ্য করে ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। উচ্চশিক্ষায় ইংরেজির ব্যবহার চালু থাকবে।’ভাষা বিষয়ক সুপারিশের কথা বললে গোটা শিক্ষানীতিতে এই ছিলো বর্ণনা। এখানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বললেও স্পষ্ট করার বিষয় হলো সকল স্তরের ভাষা মাধ্যম হবে বাংলা। সকল স্তরে বাংলার সাথে যে ভাষার প্রয়োজন ছিলো তা বলা হয়েছে। যেমন আদিবাসিদের ভাষার কথা এসেছে, ইংরেজির ভূমিকাও কয়েক স্থানে বলা হয়েছে। তবে এটা ঠিক যে, এসব ভাষা বিষয়ক সুপারিশমালার মাধ্যমে বুঝা যাচ্ছে, শিক্ষার মাধ্যমের বিশেষ কোন গুরুত্ব এ শিক্ষানীতিতে নেই। কারণ এ বিষয়ে যা বলা হয়েছে সবই এমন ঢিলেঢালা, যার নির্দিষ্ট লক্ষ্য বা করণীয় নির্ধারণ করা হয়নি।শিক্ষানীতির এসব সুপারিশের আলোচনা বাস্তবতার আলোকে দেখা যেতে পারে।প্রাক-প্রাথমিকের ভাষার কথা বলি আর বইয়ের কথা বলি, এখানে বলা হয়েছে ছবি, রং, সহজ শিক্ষা উপকরন আর ছড়া গল্পের কথা। মূলত: এ স্তরটিকে দেখানো হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষার প্রস্তুতির স্তর হিসেবে। শহরে বিভিন্ন ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে দেখা যায় প্রাথমিকের আগেই তিনটি শ্রেণী কেজি, নার্সারী ইত্যাদি নামে এসব ক্লাসে শিক্ষানীতিতে বিদ্যমান কৌশলগুলো তো বস্তবায়ন হয়ই না বরং অনেক বোঝা শিক্ষার্থীদের মাথায় চাপিয়ে দেয়া হয়। আড়াই থেকে তিন বছরেই স্কুলে যাচ্ছে শিশুরা। বাংলা তো বটেই ইংরেজির নানা বইও শিশুদের পড়ানো হয়। শিক্ষানীতি এ স্তরের জন্য কোন কারিকুলাম করেনি। খেলাধুলা বা মজার মাধ্যমে বিদ্যালয়ে আসার অভ্যাস করানোর উদ্দেশ্য হলেও বাস্তবতা তো আমরা দেখছি।প্রাথমিক শিক্ষায় আসা যাক। এখানে ভাষা মাধ্যম হিসেবে বাংলার কথা স্পষ্ট না হলেও ‘দেশজ আবহ’ বলে একটা শব্দ এসেছে। এর দ্বারা শুধু বাংলাকেই অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, সাথে সাথে বাংলাদেশের সংস্কৃতির বিষয়টিও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি ইংরেজি বলা ও লেখার জন্য কার্যক্রম নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এর সাথে আদিবাসিদের মাতৃভাষায় শিক্ষাকেও গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।রাষ্ট্রভাষা ও মাতৃভাষা দুটি ভিন্ন বিষয়। প্রত্যেক মানুষেরই মাতৃভাষায় জ্ঞান চর্চার অধিকার আছে। আমাদের শিক্ষানীতি আদিবাসিদের তাদের মাতৃভাষায় জ্ঞান চর্চার সুযোগ করে দেয়ার মাধ্যমে সে অধিকারকেই স্বীকৃতি দিচ্ছে। তারা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা শিখবে মাতৃভাষা হিসেবে নিজেদের ভাষাতো আছেই।শিক্ষানীতি যে দেশজ আবহ ও উপাদান ভিত্তিক পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক রচনা এবং অনুসরণ করার কথা বলেছে, তার সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে, আমাদের দেশে গড়ে উঠেছে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। একে তো বাংলার বা বাংলা ভাষার ছোঁয়া তো এখানে নেই, পাশাপাশি ইতিহাস, ঐতিহ্য, সমাজ-সংস্কৃতি সবই শেখানো হচ্ছে বাইরের বিশ্বে। শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশে বসেই লালন করছে অন্যদের সংস্কৃতি। একটি বাস্তব ঘটনার কথা বলা যেতে পারেÑ বঙ্গবন্ধু (যমুনা) সেতুর উপর দিয়ে যাচ্ছে বাবা আর ইংলিশ মিডিয়ামে পড়–য়া ছেলে। বাবা ছেলেকে সেতুটা দেখিয়ে বলছে, এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সেতু আর যে নদীটা দেখছো এটি দেশের অন্যতম বড় নদী। ছেলে বাবার কথা শুনে বলেছে, নদীটি নিশ্চয়ই টেমস নদীর চেয়ে বড় হবে না? অর্থাৎ ছেলে যে টেমস নদী পড়ে এসেছে সেটাই তার কাছে বড়, টেমস যমুনার চেয়ে যতই ছোট হোক না কেন।এ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ব্যাপারে শিক্ষানীতির ভূমিকা নিরব দর্শক বৈ কিছু নয়।শিক্ষানীতি প্রথম শ্রেণী থেকেই যে ইংরেজি বিষয়টি পড়ানোর কথা বলেছে তা নিয়ে অনেকেরই দ্বিমত রয়েছে। শিক্ষাস্তরের প্রথম থেকেই মাতৃভাষার বইতে এসে অন্য একটি ভাষা শিক্ষার্থীদের মাথায় উঠিয়ে দেয়া। একেতো বোঝা তার ওপর ভিন দেশি ভাষা। উন্নত বিশ্বের কোন দেশে প্রাথমিক স্তরেই মাতৃভাষার বাইরে অন্য ভাষা এভাবে শিখানো হয় না। জাপান, ফ্রান্স, স্পেন, রাশিয়া যার প্রকৃত উদাহরণ। যারা সাধারণ শিক্ষায় ইংরেজিই মেনে নিতে পারছেন না, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল মেনে নেয়ারতো প্রশ্নই উঠে না। এসব স্কুলের ব্যাপারে শিক্ষানীতির একটি দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন ছিলো। অন্তত ইংরেজি ভাষায় আমাদের প্রাথমিকের সিলেবাসগুলো অনুবাদ করে বাধ্যতামূলকভাবে সকল প্রতিষ্ঠান পড়াবে। (এখনও কিছু কিছু ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে এ পদ্ধতি চালু আছে।) আর বাংলা বিষয়টা বাংলার শিক্ষক পড়াবে। এক্ষেত্রে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলো যে আন্তর্জাতিক মান আনুসরণ করে আমাদের পাঠ্যপুস্তকগুলোও সে মানেই তৈরি হবে।মাধ্যমিক স্তরে এসে স্পষ্টভাবে প্রখম বাংলার কথা এসেছে, ‘শিক্ষার মাধ্যম এই পর্যায়ে মূলত বাংলা হবে, তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামর্থ অনুযায়ী নির্দিষ্ট পাঠ্যসূচি ইংরেজি মাধ্যমেও শিক্ষা দেয়া যাবে’। অর্থাৎ এ নীতি অনুযায়ী এ স্তরের মাধ্যম বাংলা। কিছু বিষয় ইংরেজিতে শিক্ষা দেয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের সামর্থ বলতে কি বুঝাতে চেয়েছে শিক্ষানীতি তা স্পষ্ট নয়। তবে এর দ্বারা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল যে বুঝানো হয়নি তা স্পষ্ট। নির্দিষ্ট পাঠ্যসূচি বলতে প্রাথমিক স্তর থেকে যেসব বিষয় ইংরেজিতে পড়ে আসছে সেগুলোই বুঝাবে এর সাথে হয়তো কিছু বিষয় বাড়তে পারে। এর মাধ্যমে বলা যায় মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষানীতি স্বীকৃত ভাষা মাধ্যম দুটি বাংলা এবং ইংরেজি।উচ্চশিক্ষায় ভাষা মাধ্যম হিসেবে মাধ্যমিকের মতো বাংলাটা এতো স্পষ্ট নয়। তবে বাংলার কথা এসেছে আন্যভাবে। বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ লেভেলের উচ্চশিক্ষায় ইংরেজিতে নির্দিষ্ট ক্রেডিট পড়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু বাংলার ব্যপারে এমন কোন ক্রেডিট বাধ্যতামূলক করা হয়নি। তবে বাংলাকে সম্প্রসারিত ও সমৃদ্ধ করতে ইংরেজিসহ অন্যান্য ভাষার গুরুত্বপুর্ণ রচনা বাংলায় ভাষান্তরিত করতে সুপারিশ এসেছে। উচ্চশিক্ষায় দুটি ভাগ দেখা যায়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মিডিয়াম অব ইন্সট্রাকশন বাংলা ধরা হলেও বিভাগ আনুযায়ী ভিন্নতা দেখা যায়। যে বিষয়টি প্রয়াত অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাভাষা শিরোনামের প্রবন্ধে তুলে ধরেছেন, ‘সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও বাংলার স্থান প্রায় নেই। অর্থনীতি বা হিসেব বা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বা বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিভাগ কিছুটা বেশি শক্তিমান, তাই সেগুলোতে বাংলার স্থান প্রায় নেই’। আর আমাদের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তো বাংলা পাওয়াই দুষ্কর। ইংরেজি বলতে পারুক না পারুক অন্তত বাংলা চলে না। অবারও হুমায়ুন আজাদ ‘বাংলাদেশের অসাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় বা মহাবিদ্যালয়গুলো অবস্থিত অনেকটা বাংলাভাষা এলাকার বাইরে; সেখানে বাংলার অধিকার নেই; কারণ সেগুলো খুবই শক্তিমান’।পড়ার বিষয় হিসেবে বাংলা প্রাইভেট বিশ্ববিদালয়ে নেই। কর্পোরেট মার্কেট চাহিদার বিষয়টি মাথায় নিয়ে বিবিএ ইংরেজি এমন দু’একটি বিষয় নিয়েই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষানীতির এ ব্যাপারে তেমন কোন মাথাব্যথা পরিলক্ষিত হয়নি।ভাষা মাধ্যম নিয়ে চূড়ান্ত কোন কথা বলা না গেলেও বলা যায়, এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোন নীতি নেই। প্রাথমিক স্তর থেকেই শিক্ষার্থীরা বাংলা পড়ে আসছে, তার সাথে ইংরেজির লেজ তো লাগানো আছেই। এরপরও শিক্ষার্থীরা বাংলা ব্যবহার করতে জানে না, ইংরেজি তো অনেক দূরে। এর অর্থ ভাষা নিয়ে আমাদের পরিকল্পিত কোন চিন্তা নেই। গল্প কবিতার সিলেবাস বাস্তব ময়দানে কোন কাজ দেয় না। ভাষার যে চারটি দক্ষতা আছে শোনা, বলা, পড়া এবং লেখা এগুলোর আলোকে বাস্তবধর্মী সিলেবাস প্রণয়ন করা দরকার। এ লক্ষ্যে কয়েক বছর ধরে ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে কম্যুনিকেটিভ পদ্ধতিতে ইংরেজি বিষয়টি চালু হয়েছে। এ পদ্ধতিতে ইংরেজি ভাষার দক্ষতাগুলো আয়ত্ত আসার কথা থাকলেও কাংখিত ফল কিন্তু আসেনি। সমস্যাটা শিক্ষাদানে। আমাদের বিদ্যালয়গুলোতে যেসব শিক্ষকরা পাঠ দেন, তাদের অধিকাংশেরই ইংরেজির এসব দক্ষতা বলতে গেলে শূন্য। ফলে পরীক্ষায় পাশ ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্য হাসিল হয় না। আবার বাংলায় শিক্ষকরা শ্রেণীকক্ষে মানভাষা ব্যবহার করেন না। শিক্ষার্থীরাও শিখে না।উন্নত বিশ্বের অনেক দেশের মতো শুধু আমাদের রাষ্ট্রীয় ভাষা বাংলাকে এ পর্যায়ে নিয়ে এসে একমাত্র শিক্ষার মাধ্যম করা সম্ভব নয়। তবে অনেকে এ কথা মানতে নারাজ। বাস্তবতা হলো, বর্তমান প্রযুক্তির পৃথিবীই বলি আর বিশ্বায়নই বলি গ্লোবাল ভিলেজে শুধু বাংলা নিয়ে বেঁচে থাকা বা সামনে এগিয়ে যাওয়া অনেক কঠিন। জাপান, ফ্রান্স, রাশিয়া বা অন্যান্য দেশ কিভাবে সম্ভব করেছে? প্রশ্নটা অস্বাভাবিক নয়। এসব দেশ তাদের মাতৃভাষাকে নিয়ে বিশেষ টার্গেটে এগিয়েছে। নিজেদের ভাষায় যেমন আধুনিক বিশ্বেও আপডেট গ্রন্থ রচনা করেছে। তাদের ভাষা ছাড়াও অন্য যে ভাষাতেই উন্নত কোন বই বা প্রকাশনা এসেছে সাথে নিজেদের ভাষায় অনুবাদ করে ফেলেছে। তাদের শিক্ষার্থীরা গোটা পৃথিবীর আপডেট জ্ঞানকে নিজের ভাষায় পেয়েছে। মাতৃভাষার মাধ্যমেই উন্নতি করেছে।আমাদের বাংলায় সমৃদ্ধ সাহিত্য বা বইয়ের অভাব নেই বটে কিন্তু এর বাইরে এর চেয়ে অনেক প্রকাশনা রয়েছে। যা আমরা বাংলায় অনুবাদ করতে পারিনি। পৃথিবী যত দ্রুত এগুচ্ছে সকল জ্ঞান ভা-ারকে বাংলায় অনুবাদ করে মাতৃভাষায় শিক্ষাদান সম্ভব নয়। উচ্চশিক্ষায় কৃষির কথা বলি, যারা দেশের মাটি, ফসল, খাদ্য নিয়ে গবেষণা করছে তাদের ইংরেজিতে রচিত বই পড়তে হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষায় বাংলায় কয়টা বই আছে? প্রকৌশলে কিংবা অন্যন্য বিষয়ে বাংলার কয়টা বই আমরা পাব?মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষা নিয়ে অনেকেই জোর গলায় কথা বলেন। সেটা হলে ভালোও হতো, আমরা নিজেদের ভাষায় পড়ে দ্রুত উন্নতি করতে পারতাম। বিশ্বপরিক্রমায় বর্তমান পর্যায়ে সৎসাহস নিয়ে এ কথা বলাটা কঠিন। এ সাহস দেখানো যেতে পারে এখন থেকেও যদি পরিকল্পিতভাবে অগ্রসর হওয়া যায়। রিস্ক থেকেই যাবে, তবুও চ্যালেঞ্জ নেয়া যেতে পারে। প্রথম কাজটা হতে পারে ব্যুরো অব ট্রান্সলেশন অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অনুবাদ সংস্থা গড়ে তোলা। যেটি আধুৃনিক বিশ্বের জ্ঞান ভা-ারকে অনুবাদ করবে। দ্রুত গতিতে এ কাজকে এগিয়ে নিতে আমাদের মেধাবীদের বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে কিংবা প্রবাসী বাঙ্গালীদের কাজে লাগানো যেতে পারে। অনুবাদ বা ভাষান্তরের বিষয়টি শিক্ষানীতিতেও এসেছে,’ উচ্চশিক্ষায় বাংলা সম্প্রসারিত ও সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে ইংরেজিসহ অন্যান্য ভাষার রচিত আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের ব্যবহারযোগ্য গুরুত্বপূর্ণ রচনা বাংলা ভাষায় ভাষান্তরিত হওয়া প্রয়োজন।’এছাড়া আমাদের বিদ্যমান ব্যবস্থায়ও অগ্রসর হওয়া যায়। বাংলা এবং ইংরেজি যেভাবে শিক্ষার্থীরা একসাথে শিখছে সেটা থাকবে, তবে কারিকুলাম হবে বাস্তবমুখী। প্রাথমিক, মাধ্যমিক স্তর শেষ করার পর উচ্চশিক্ষায় ইংরেজি পড়তে যাতে কাউকে হোচট খেতে না হয়। সে কারিকুলাম শিক্ষার্থীর বয়স, মনন, বুদ্ধির আলোকে বাস্তবমুখী হবে। এর সাথে যোগ্য শিক্ষকম-লীরও সমাবেশ ঘটানো যেতে পারে। ২১ তারিখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট উদ্বোধন করেছেন। এ ইনস্টিটিউট সত্যিকারার্থে আমাদের মাতৃভাষা বাংলা নিয়ে গবেষণা করে, বাংলাকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়। শিক্ষানীতি আমাদের ভাষা মাধ্যমে যে কৌশল নির্ধারণ করেছে সেগুলোর বাস্তবায়ন এবং এ নীতি চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে বাস্তবমুখী কিছু ব্যবস্থা নেয়ার মাধ্যমে শিক্ষার মাধ্যমকে শক্তিশালী করা যায়।

বন্ধ হয়নি সীমান্তে নিরীহ মানুষ হত্যা (ৈদিনক েডসিটিন ১৭-০২-২০১০)




বন্ধ হয়নি সীমান্তে নিরীহ মানুষ হত্যা
মাহফুজুর রহমান মানিক

ভারত আমাদের বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী রাষ্ট্র। আয়তনে ভারত বাংলাদেশের চাইতে কয়েক গুণ বড়। ভারত যেমন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশও তেমন। আয়তনে বড় বলে তাদের সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিএসএফ-এর এ অধিকার নাই যে তারা বাংলাদেশীদের হত্যা করবে। আশ্চর্য়ের বিষয় হলো যখন আমাদের দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরে যাচ্ছেন ঠিক তার প্রাক্কালে এবং সে দেশে আবস্থানকালীন সময় ও বিএসএফ আমাদের নিরীহ মানুষদের হত্যা করছে। গত মাসের ১০ জানুয়ারি ছিলো প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর, এর আগের দিন ৯ জানুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং বেনাপোল সীমান্তে মনিরুল ইসলাম এবং হজরত আলী নামে দুজনকে হত্যা করে বিএসএফ। এদের একজন নিরীহ কৃষক আরেকজন গরু ব্যবসায়ী। আগে যেটা দেখা যেতো শুধু গুলি করে হত্যা, এবার পিটিয়েই হত্যা করেছে গরু ব্যবসায়ীকে। ১০ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী ভারত গেলেন। ১২ তারিখ তিনি তখনও ভারতে সে অবস্থায়ও দৌলতপুর সীমান্তে ১ জনকে গুলি করে হত্যা করেছে ১ জনকে। ১৩ তারিখ প্রধানমন্ত্রী সফর শেষ করে বাংলাদেশে আসেন সেদিন সাতক্ষীরা সীমান্তে ১ জন নিহত হয় বিএসএফ-এর হাতে।আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে অন্তত কয়দিনের জন্য হলেও এ হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করা যেতো। যাই হোক প্রধানমন্ত্রীর সফর সফল। প্রধানমন্ত্রী তার সফরে নিশ্চয়ই বিএসএফ-এর এ খুনি আচরণ বন্ধের বিষয়টি উল্লেখ করছেন বলেই আমাদের বিশ্বাস। কিন্তু বাস্তবতা হলো তাঁর সফরের আগে, সফরকালীন সময়ে এবং এর পরের বিএসএফ-এর সে নিরীহ মানুষ হত্যার চিত্রের কোন পরিবর্তন ঘটেনি। বরং বেড়েই চলেছে খুনের পাল্লা। গত ১৪ তারিখ রোববার এর আগে ৬ ফেব্রুয়ারি, ৪ ফেব্রুয়ারি, ৩০ জানুয়ারি, ২৮ জানুয়ারি ও এ হত্যাকা- হয়েছে। কাউকে মেরেছে গুলি করে আবার কাউকে পিটিয়ে।শেষ ১৪ ফেব্রুয়ারি বিএসএফ-এর অতর্কিত গুলিতে এক মহিলাসহ আহত হয়েছেন চার বাংলাদেশী। সীমান্তের একই স্থানে ৪ ফেব্রুয়ারি গুলি চালিয়ে এক বিডিআর সদস্যকে হত্যা করে বিএসএফ। লাশ নিয়ে যাওয়ার একদিন পর ফেরত দেয় তারা। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর সফরের পরও আগের হিংস্রতা কমেনি। ইড়ঃঃড়স ড়ভ ঋড়ৎসএর আগে এ সমস্যার সমাধানে গত ১০ জুলাই থেকে ১৪ জুলাই বিডিআর ও বিএসএফ-এর মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠক হয়। ঢাকার বিডিআর সদর দপ্তর পিলখানায় অনুষ্ঠিত হয় এ বৈঠক। বৈঠকের সফলতার কথা বলেছিলেনন দুই মহাপরিচালক-ই। বৈঠক সফল হলেও কতটা সুখকর হয়েছে তাই প্রশ্ন। প্রথম দিনের ঘটনা ছিলো সত্যিই দুঃখজনক। তিন দিনের বৈঠকের বসতে না বসতেই খবর বিএসএফের গুলিতে দুজন বাংলাদেশি নিহত। আশ্চর্য বৈ কি! নিস্ফল দুটি প্রাণ। কোনো কারণ নেই। একজন কৃষক। মাঠে কাজ করছেন। হঠাৎ বিএসএফের গুলি। সাথে সাথে প্রাণ হারান। অন্যজন ব্যবসায়ী। গরু কিনে বাংলাদেশে আসছেন। বিএসএফের গুলিতে তিনিও প্রাণ হারান। নিরীহ প্রাণগুলো ঝরে যাচ্ছে। নির্বিকার বিএসএফ। বৈঠক হয়েছে অনেক। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বিএসএফ দাবি করেছে নিহতদের মধ্যে ৮৫ ভাগই অপরাধী। গুলির যত ঘটনা ঘটেছে সবই রাতে। বিএসএফ বিশ্বের সবচাইতে বড় গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী। ভারতের সীমান্ত রক্ষায় অতন্ত্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করছে তারা। শ্রদ্ধা করি তাদের। কিন্তু সীমান্তের এ হত্যাকা-ে বিএসএফ-এর যুক্তি কতটা বাস্তব সম্মত। সেদিন দুজনের হত্যা কী প্রমাণ করে। তারাতো রাতে নিহত হননি তারা চোরা কারবারীও ছিলেন না। অতীতের এ নিরীহ মানুষ গুলি করে হত্যার দৃশ্য আরো করুণ বিএসএফ জানুয়ারি ২০০৯ থেকে বৈঠকের প্রথম দিন অর্থাৎ ১০ জুলাই পর্যন্ত ৫৯ বাংলাদেশীকে গুলি করে হত্যা করেছে। মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ এর দেয়া তথ্য মতে, গত ১০ বছরে বিএসএফ এর হাতে ৮৪৮ জন বাংলাদেশী নিহত হয়েছে আহতের সংখ্যা ১০০০ এর মত। এছাড়াও ধর্ষণের ঘটনাও ঘটেছে, অনেক বাংলাদেশী ধরে নিয়ে গেছে যাদের কোম হদিস মেলেনি।বিএসএফ-এর গুলিতে ২০০৮ এ মোট নিহত হয়েছে ৬২ জন। জানুয়ারি ২০০৮ থেকে ১০ জুলাই, বিডিআর-বিএসএফ বৈঠকের প্রথম দিন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ১২১ জন। ২০০৭ এ নিহত হয়েছে ১২০ জন। ২০০৬ এ ১৪৬ জন ২০০৫ এ ১০৪ জন। ২০০৪ এ ৭৬ জন। ২০০৩ এ ৪৩ জন। ২০০২ এ ১০৫ জন ২০০১ এ ৯৪ জন এবং ২০০০ সালে ৩৯ জন নিরীহ বাংলাদেশী নাগরিক বিএসএফ-এর গুলিতে নিহত হয়েছে।এ ১০ বছরে বিডিআর-বিএসএফ বৈঠকের সংখ্যাও কম ছিলো না। বিডিআর-বিএসএফ সমঝোতাও হয়েছে অনেক বার। কিন্তু বেপরোয়া বিএসএফ, কোন চুক্তি, সমঝোতা কিংবা অলোচনাকে আমলে নেয়নি তারা।বাস্তবে দেখা গেছে সীমান্তে গুলিতে যারা নিহত হয়েছেন অধিকাংশই কৃষক। যারা কৃষি কাজ করে জীবন ধারণ করেন। এছাড়াও নিহতদের মধ্যে রয়েছে জেলে, শ্রমিক, ছাত্র, যুবক, রাখাল, নারী এমনকি শিশুও। ভারত বলেছে তাদের সীমানায় তারা অপরাধীদের হত্যা করেছে, অথচ বাস্তবতা হচ্ছে এরা অধিকাংশই গুলিবিদ্ধ হয়েছে বাংলাদেশ সীমানায়। ৪১৪৪ কিলোমিটার সীমান্ত-এর মধ্যেই এত হত্যা। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকার মধ্যে বিএসএফ-এর গুলিতে বেশি নিহত এলাকাগুলো হলো- সাতক্ষীরা, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, জয়পুরহাট, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁ, পঞ্চগড়, লালমনিরহাট এবং কুড়িগ্রাম।এসব এলাকার সীমান্তবর্তী মানুষ খুবই গরিব। অধিকাংশই কৃষি কাজ করে খায়। এছাড়াও মাছ ধরে কিংবা কোন মতে জীবন ধারণ করে। এ অসহায় মানুষগুলো সবসময়ই বিএসএফ-এর গুলির ভয়ে তটস্থ থাকেন ।বিএসএফ-এর এ বেপরোয়া ভাবের কথা খোদ ভারতেও শোনা যাচ্ছিল। ভারতের মোচা নামক একটি মানবাধিকারণ সংগঠন তাদের এক জরিপে বলেছে, ২০০৮-এর জানুয়ারি থেকে ১৩ জুলাই ২০০৯ পর্যন্ত এ ১৯ মাসে বিএসএফ-এর হাতে ভারতেরই ১৮ জন নাগরিক মারা গেছে।বাংলাদেশী নাগরিক হত্যা সম্পর্কে বিএসএফের বক্তব্য গুলিতে নিহত হওয়া ৮৫ ভাগই অপরাধী। তাদের এ বক্তব্য যদি সঠিকও হয়, অপরাধী হলেই কী তাদের দেখা মাত্রই গুলি করতে হবে? গুলি করে হত্যাই কী সমাধান? এ ছাড়া বুঝি কোন পথ নেই। দেখা মাত্রই গুলির প্রবণতা বন্ধ হওয়া উচিৎ চোরাকারবারী, সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ী, নারী-শিশু পাচারকারীদের মতো অপরাধীদের বিরুদ্ধে সীমান্তে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে। সেটা যে দেখলেই সাথে সাথে গুলি, তা নয়। গুলির এ প্রবণতার ফলে নিরীহ মানুষ বিনা অপরাধে মারা পড়ছে। আবার সীমান্তে অনেক সময় সীমানা চিহ্নের খুটি দেখা যায় না, ভুলে কেউ ওপারে গেলেই গুলি চালায় বিএসএফ।বিডিআর-বিএসএফ বৈঠকে অবশ্য এ নিরীহ নাগরিক হত্যার বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছিলো। বিএসএফের মহাপরিচালক মাহেন্দ্র লাল কুমাওয়াত এ হত্যা বন্ধের অঙ্গীকার করেছেন। ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে পাকিস্তান-ভারত সীমান্তের মত যৌথ টহলের ব্যবস্থা করলে হয়তো এ হত্যা বন্ধ হতে পারে।ভারত আমাদের প্রতিবেশী দেশ। প্রতিবেশী বললেও পরিচয়টা খাটো হয়ে যায়। ভারত গোটা বাংলাদেশকে ঘিরে রেখেছে। প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশ ভারতের সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। এ ব্যাপারে ভারতের আগ্রহ সেভাবে লক্ষ্যণীয় নয়।বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তে অনেক অমীমাংসিত সমস্যা রয়েছে। প্রায় সাড়ে ছয় কিলোমিটার সীমানা চিহ্নিত করা এখনো বাকি রয়েছে। আমাদের তালপট্টি দ্বীপ রয়েছে ভারতের দখলে। ছিটমহর সমস্যা জিইয়ে রেখেছে ভারত আমাদের উপকূলীয় গ্যাস-তেল ক্ষেত্রগুলোকে আন্তর্জাতিক লিজ দেয়ায় বাধা সৃষ্টি করে আন্তর্জাতিক ফোরামে এগুলোর মালিকানা দাবী করে বসেছে। একবার ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশের একাংশকে মরুকরণের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এখন আবার টিপাইমুখ বাঁধ দেয়ার উদ্যোগ নিয়ে বাংলাদেশে অন্য একটি বিস্তীর্ন অঞ্চল বিপর্যস্ত করে তোলার পথে। ভারতের সাথে আমাদের দ্বিপাক্ষিক বিভিন্ন ইস্যু থাকলেও অন্তত নিরীহ মানুষ হত্যার বিষয়টির জরুরি সমাধান হওয়া দরকার। সীমান্তে বারবারই জিরো টলারেন্স নীতির কথা শোনা যায়। কিন্তু বাস্তবে ফলে না। আমাদের নিরীহ বাংলাদেশীদের গুলি করে, পিটিয়ে এমনকি বিদ্যুতের শক দিয়ে মারছে। এগুলো কখনোই মেনে নেয়ার মতো নয়। পাশাপাশি দুই দেশের উন্নয়নে বন্ধুত্ব জরুরি। এর জন্য আলোচনার বিকল্প নেই। সীমান্তে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা দুই দেশের অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের অন্যতম শর্ত। আমরা প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের কাছ থেকে প্রতিবেশী সুলভ আচরণই চাই। এটা সত্যিকারই দুঃখজনক এভাবে প্রতিনিয়ত আমাদের নিরীহ লোকগুলো প্রাণ হারাবে। এ বিষয়ে সমঝোতা বৈঠক হলেও বাস্তবে ফলবে না।বর্তমান সরকারের সাথে ভারতের সম্পর্ক অনেক ভালো বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ ভালো সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে এ বিষয়টির ফয়সালা করা সময়ের দাবী। সরকার নিশ্চয়ই চাইবেন না আমাদের নাগরিকরা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর হাতে এভাবে মারা পড়–ক। দেশের স্বার্থে, নাগরিকের কল্যাণে এ ব্যপারে সরকারের কিছু করা আবশ্যক। সীমান্তের সাথে জড়িত তাদের কর্র্র্তৃপক্ষ এবং রাষ্ট্রের উচ্চ মহলে আলোচনা বা যেভাবে সম্ভব একটা সমাধান সবাই চায়।আমাদের বিশ্বাস বিএসএফকে তাদের খুনি আচরণ বন্ধ করতে সরকারের উদ্যোগ কাজে দিবে। নিরীহ কোন বাঙ্গালী আর এভাবে বিনা বিচরে মারা যাবে না। য়